এস এল টি তুহিন,বরিশাল :: বরিশালের স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন ঐতিহ্যবাহী মিয়াবাড়ি মসজিদ । দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদ শুধু বরিশালের নয়, বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর অন্যতম। বরিশাল সদর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার উত্তর কড়াপুর গ্রামে অবস্থিত দ্বিতল এ মসজিদটি মিয়া বাড়িতে এটি নির্মিত হয় ব্রিটিশ আমলে। মনে করা হয়ে থাকে ১৮শ শতকে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এখনো নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয় মসজিদটি,বর্তমানে প্রতিনিয়ত ভ্রমণ পিপাসু দূর-দূরান্ত থেকে প্রচুর পর্যটক ঘুরতে আসে মুঘল আমলে নির্মিত বরিশালের এ ঐতিহ্য দেখতে।
ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তৎকালীন হায়াত মাহামুদ এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদের সাথে দুটি বিশালাকার দীঘিও খনন করেন। যা মসজিদটির সৌন্দর্যকে আরো নয়নাভিরাম করে তুলেছে। মসজিদটি লম্বায় প্রায় ৭০ ফুট এবং প্রস্থে ৪০ ফুট। বলা হয় চুন, সুরকির সঙ্গে মাষকলাই ও চিটাগুড় পচিয়ে এর নির্মাণসামগ্রী তৈরি করা হয়েছিল। এর অন্যতম নির্মাণবৈশিষ্ট্য হলো, ছাদে কোনো ধরনের রড কিংবা লোহার ব্যবহার হয়নি। ইট, সুরকি ও চুনের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি ছাদের পুরুত্ব প্রায় এক ফুট । মসজিদটি দ্বিতলবিশিষ্ট ও সম্পূর্ণ কারু কার্যমণ্ডিত। মূল মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে দ্বিতীয় তলায়। নিচ তলায় রয়েছে ছয়টি দরজা বিশিষ্ট আবাসন ব্যবস্থা। যেখানে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য করা হয়েছে থাকার ব্যবস্থা। মসজিদের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে তিনটি দরজা।
ছাদের মাঝখানে রয়েছে বড় তিনটি গম্বুজ। মাঝেরটি সবচেয়ে বড়। ভিতরের অংশেও রয়েছে কারুকার্যময় সুন্দর নকশার সমাহার। চারপাশে পিলারের ওপর নির্মিত হয়েছে আটটি বড় মিনার। বড় মিনারগুলোর মাঝে রয়েছে ১২টি ছোট ছোট মিনার। ছোট মিনারগুলোর মাঝের স্থানকে সুন্দর কারুকার্যময় নকশা দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়েছে। মসজিদের দ্বিতীয় তলায় উঠার জন্য প্রশস্ত সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ির নিচে দুটি বাঁধানো কবর রয়েছে। কিন্তু ওই কবর কাদের সেটা জানেন না এলাকার মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হায়াত মাহমুদ সম্ভবত মালদার খাঁর ছেলে, যিনি চন্দ্রদ্বীপের রাজার সামরিক ফৌজে নিযুক্ত ছিলেন। মাহমুদও চন্দ্রদ্বীপ সামরিক ফৌজে ভর্তি হন। একবার, নিকটবর্তী চাখার এলাকার মীর ও মজুমদার জমিদার খান্দানদ্বয় চন্দ্রদ্বীপের রাজাকে অপহরণ করে। গভীর রাতে রাজাকে আজাদ করে মাহমুদ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এই কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রাজা দুটি তালুক প্রদান করেন মালদার খাঁ এবং হায়াত মাহমুদকে, যা পরবর্তীতে কড়াপুরের মিঞা খান্দান (মাহমুদের বংশধরদের) দ্বারা ওয়ারিশসূত্রে পাওয়া যায়। বুজুর্গ-উমেদপুর পরগণাও হায়াত মাহমুদের তালুকগুলির মধ্যে একটি ছিল ।
আরও জানা গেছে, দক্ষিণ বাংলার একজন মজবূৎ জমিদার হয়ে উঠলে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাহমুদের মর্যাদার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মাহমুদ বাংলায় কোম্পানির শাসন মেনে-চলতে এবং বুজুর্গ-উম্পেদপুর পরগণা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন। ফলস্বরূপ, ইংরেজ কোম্পানি বরিশালের সমস্ত জলপথ বন্ধ করার নির্দেশ দিলো। মাহমুদকে ডাকাত সরদার হিসাবে এলান করা হয়। কোম্পানির সিপাহীরা ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁকে বন্দী করতে সক্ষম হয় এবং তাঁকে জাহাঙ্গীরনগরের তৎকালীন নায়েব নাজিম ইংরেজপন্থী নুসরত জং-এর কাছে নিয়ে যায়। ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে নায়েব নাজিম মাহমুদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার পরামর্শ দেন। লর্ড কর্নওয়ালিস মাহমুদকে ব্রিটিশ মালয় প্রিন্স অফ ওয়েলস দ্বীপে নির্বাসিত করেন এবং বুজুর্গ-উমেদপুরের জমিদারি কেড়ে নেন। মাহমুদ ১৮০৬ খ্রীষ্টাব্দে আজাদী পান এবং তারপরে শান্ত জীবনযাপন শুরু করেন। কড়াপুরে ৩০ একর জমিতে বাড়ি তৈরি করেন তিনি। মাহমুদকে ১৮০৭ খ্রীষ্টাব্দে মিয়া বাড়ি মসজিদ প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেওয়া হয়,যদিও অল্প কয়েকজন দাবি করেছে যে মসজিদটি তাঁর ছেলে মাহমুদ জাহিদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মাহমুদ জাকির নামে তার আরেকটি ছেলেও ছিল ।
স্থানীয় আবুল কালাম আজাদ নামের এক মসজিদের মুসল্লি চন্দ্রদীপ নিউজকে জানান, হায়াত মাহমুদ নামে এক ব্যক্তি মিয়াবাড়ি মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা করেন বলে আমরা জানি । মোগল আমলের এ স্থাপনাটি দেখতে অনেক মানুষই ছুটে আসেন। কিন্তু যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সড়কটি সংস্কার না করায় যাতায়াতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তৎকালীন ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নির্বাসিত হন তিনি। এ সময় তার জমিদারিও কেড়ে নেয়া হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর পর দেশে ফিরে তিনি এলাকায় দু’টি দীঘি ও দ্বিতল এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।
কড়াপুর মিয়াবাড়ি জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মো: জামাল উদ্দিন চন্দ্রদীপ নিউজকে জানান, আমি প্রায় ৩৩ বছর ধরে এই মসজিদে ইমামতী করে আছি। আমাদের পূর্বপুরুষ ও মুরুব্বিগণ বলে থাকেন এটি মোগল সম্রাটের সময় এটি নির্মাণ করা হয়েছে। আনুমানিক ৭শত বছরের আগে এটা তৈরি করা হয়েছে।
তিনি জানান, বর্তমানেও মিয়া বাড়ির যে বংশধর তারাই এই মসজিদটি এখনো পরিচালনা করে থাকেন। এই মসজিদটি সিঁড়ির নিচে দুইটি কবর রয়েছে। তবে কেউ জানেন না এ কবর দুটি কাদের। তবে ধারণা করা হচ্ছে যারা এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা তাদের স্বামী-স্ত্রীদের দুই জনের এ কবর আবার বলে হয়ে থাকে মাহমুদ হায়াতও মাহমুদ জাহিদ তাদের দুই ভাইয়ের কবর । যারা এই মসজিদটি তৈরি করেছে তারা খুব ভালো মানুষ ছিল সেই সময় তারা মনে করছিল এই মসজিদের দোতলায় উঠতে হলে সিড়ির নিচে তাদের কবর থাকলে অনেক আল্লাহর ওলী বুজুর্গ এখানে পর্দচারণা করার কারণে আল্লাহ তাদের গুনার্হ মাফ করে দিবেন এমন অনুমাণ করে মানুষ । এ মসজিদটিতে এক সাথে ১শত মানুষের অধিক নামাজ আদায় করতে পারে। ২০১৩ সালে এটা কিছু সংস্কার করা হয়েছিল । এখানে প্রতিদিন অনেক মানুষ মসজিদটি দেখতে আসেন ও অনেকেই নামাজ আদায় করেন ।
মসজিদটি দেখতে আসা রাহাত রাব্বি নামের এক দর্শনার্থী চন্দ্রদীপ নিউজকে জানান,আমার জীবনের প্রথম কোন পুরানো দিনের জিনিস দেখলাম সেটা এত কারুকার্য নকশা করা যা যত দেখি আরো বেশি ভালো লাগে । এখানে এসে জামাতে নামাজ আদায় করলাম বাহিরে গরম থাকলেও মসজিদটির ভিতরে অনেক ঠান্ডা । এটাই আমার কাছে আরো ভালো লাগলো ।
জমিদারী মিয়া বাড়ির বংশধর মো: মিজানুর রহমান চন্দ্রদীপ নিউজকে জানান, ইসলাম প্রচারের জন্য পারর্শ দিয়ে এসে মাহমুদ হায়াতও মাহমুদ জাহিদ এই মসজিদ নিমাণ করেছেন তাদেরও পৃর্ব পুরুষ এই জায়গায় এসে বসবাস শুরু করতেন । এখানেই ২ টা বাড়ি আমারা তাদের এই ১৩ তম বংশধর । তারা এই দেশের শাসন করে ছিল ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কিছু নির্যাতিত হয়েছিল। অমিতপুরে তাদের আরও একটি জমিদারি ছিল সেটিও তারা নিয়ে নিয়েছিল দীপান্তরে অনেক মানুষকে তারা যাবজ্জীবন দিয়ে হত্যা করেছিল। আমাদের পূর্বপুরুষ থেকে শুনেছি পরবর্তীতে তাদের এক শাষক মাহমুদ জাহিদ উনার মুক্তির জন্য বাঁশি বাজিয়ে আন্দোলন করা হয়েছিল তখন। তারপর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এই মিয়া উপাধি এটা ব্রিটিশ রায়াই দিয়েছেন। আমাদের পূর্বের বংশ পুরুষ আসলে আগে ছিল তারা মালদার খান। ব্রিটিশদের দেওয়া নামেই থেকেই মিয়া উপাধি আমাদের বংশধররা ব্যবহার করে আছে। আমার আপন বড় চাচাও আব্দুল মান্নান মিয়াও জমিদারি করেছেন। তারপর শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সময় জমিদারি প্রথা স্থগিত হয়। আমাদের জমিদারী চলে যায় ।
তিনি জানান, ১৯৯০ সালে আমাদের কিছুটা সমস্যা হয়েছিল তখন আমার বড় চাচা আব্দুল মান্নান মিয়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে এটি কিছুটা সংস্কার করেন । তারপর আমার ভাই আবার হাইকোর্টের রিট করে এটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এনে ২০১৩ সালে আমারা এককভাবে সংস্কার করি । এখানে প্রতিনিয়ত দেশ বিদেশ থেকে হাজাও মানুষ এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন নিদর্শন দেখতে আসেন বেশ কয়েক বছর আগে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ও ভারতের রাষ্ট্রদূত এই মসজিদটি পরিদর্শন করেছিলেন এছাড়াও দেশের বেশ কয়েকটি দেশের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এখানে এসেছিলেন।