পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: ‘কোনো কালেই আমার কপালে সুখ জুটলো না! ছোটবেলায় বাবাকে হারালাম। ঢাকায় পরের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলাম। ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা শিখে মানুষের মতো মানুষ হবো। কিন্তু অভাবের কারণে তা আর হলো না। মা-ভাই দেখেশুনে বিয়ে দিলো। সেখানেও শ্বশুর-শাশুড়ির নির্যাতন। এখন স্বামী-সন্তান নিয়ে ভাইয়ের ঘরে থাকি। ঠিকমতো খাবারও পাই না। নিজেদের মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই আর ছেলেটাকে যদি মানুষ করতে পারতাম, তাহলে জীবনে আর কিছু চাইতাম না।’
এ ভাবেই নিজের দুঃখের কথা বলছিলেন আদুরী বেগম।
২০১৩ সালে ঢাকার পল্লবীতে গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সংবাদপত্রের শিরোনাম হন আদুরী বেগম। এ ঘটনায় সে বছর ২৬ সেপ্টেম্বর পল্লবী থানায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী, তার স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ, মাসুদের ভগ্নিপতি চুন্নু মিয়া ও তাদের আত্মীয় রনিকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন নওরীন।
আরো পড়ুন : সুলতান আহমেদ হাওলাদারের দাফন সম্পন্ন
আদুরীর গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের জৈনকাঠি গ্রামে। তারা নয় ভাই-বোন। তার বয়স যখন ছয় বছর, তখন বাবা খালেক মৃধা মারা যান। অভাবের সংসারে দু’মুঠো ভাতের জন্য গ্রামের চুন্নু মিয়ার কাছে আদুরীকে কাজের কথা বলেন তার মা। চুন্নু মিয়া প্রথমে বরিশালের শায়েস্তাবাজার এলাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে কাজ দেন আদুরীকে। সেখানে এক বছর কাজ করার পর তিনি ঢাকার পল্লবীতে তার শ্যালক সাইফুল ইসলাম মাসুদের বাসায় আদুরীকে কাজ দেন।
আদুরী বলেন, ‘তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। ঠিক মতো কাজ করতে পারতাম না। সবসময় কারণে-অকারণে আমাকে মারধর করতো। ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দিত, আগুন দিয়ে জিহ্বা পুড়িয়ে দিয়েছে। ব্লেড দিয়ে হাত-পা কেটে দিয়েছে। আমাকে বাসি, পচা ভাত দিত। তার মধ্যে অনেক লবণ দিয়ে রাখতো যাতে আমি খেতে না পারি। আদা বাটা, রসুন বাটা জোর করে খাওয়ানো হতো। এখনও সারা শরীরে মাঝে মাঝে ব্যথা করে। ভাত খেতে পারি না, গলা ও পেট জ্বলে। জিহ্বা পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে স্পষ্ট করে কথা বলতেও কষ্ট হয়।’
আদুরীর পরিবারের লোকজন জানান, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাইফুল ইসলামের বাড়িতে থাকাকালীন আদুরীর ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। এ সময় গৃহকর্তী নওরীন জাহানের তীব্র রোষের শিকার হয় সে। খাবার এবং পুষ্টির অভাবে কঙ্কালসার হয়ে পড়ে ছোট্ট আদুরী। ওই বছর ২৩ সেপ্টেম্বর নির্যাতনের পর মারা গেছে ভেবে আদুরীর ক্ষত-বিক্ষত দেহ রাতের অন্ধকারে পল্লবী এলাকার একটি ডাস্টবিনে ফেলে রেখে যায় নওরীন। পরদিন সকালে ডাস্টবিন থেকে আদুরীকে উদ্ধার করেন লিলি আক্তার নামে এক পথচারী। পরে খবর পেয়ে পল্লবী থানা পুলিশ আদুরীকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে তার চিকিৎসা চলে। গঠন করা হয় মেডিক্যাল বোর্ড। এক মাস চিকিৎসা শেষে আদুরী বাড়ি ফিরে আসে।
আরো পড়ুন : ছুটিতে হল বন্ধ করায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি
আদুরী বর্তমানে স্বামী ও দেড় বছরের সন্তানকে নিয়ে তার ভাইয়ের বাড়িতে অবস্থান করছেন। ২০২২ সালে পার্শ্ববর্তী আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের মো. ইমরানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতেও সুখ জোটেনি আদুরীর কপালে।
আদুরী বলেন, ‘শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এক বছর আগে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছি বড় ভাই জুয়েলের ঘরে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, ঘরটি ছোট। এখানে-ওখানে ভাঙা। এই ভাঙা ঘরেই নয়জন মানুষকে থাকতে হচ্ছে। করতে হচ্ছে মানবেতর জীবনযাপন।
আদুরী জানান, তার স্বামী জেলে। এখন সাগর ও নদীতে মাছ কম পাওয়ায় আরো অসহায় অবস্থায় দিন কাটছে তার।
তিনি ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার কপালে আল্লাহ সুখ রাখেননি। সেদিন ডাস্টবিনে যখন পড়ে ছিলাম, একেবারে মরে গেলেই হয়তো ভালো হতো। এখনও অশান্তির শেষ নাই। স্বামীর জালে মাছ উঠলে কপালে ভাত জোটে, না হলে না খেয়ে থাকতে হয়।’
আদুরীর প্রতিবেশী রহমান খা বলেন, ‘আমরা গ্রামবাসীরা টাকা তুলে আদুরীকে বিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতেও তার সুখ হয়নি। মেয়েটা জনমদুঃখী।’
হোসনেয়ারা নামে আরেক প্রতিবেশী বলেন, ‘ওর (আদুরীর) স্বামী সাগরে মাছ না পেলে এখনও অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়। আমারা প্রায়ই সহযোগিতা করি। তার একটা থাকার ঘর খুব দরকার। সমাজের বিত্তবানরা আদুরীর পাশে দাঁড়ালে তার সন্তানের লেখাপড়াও হতো, পরিবারও ভালোভাবে চলতে পারতো।’
পটুয়াখালী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্জীব দাশ বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি তেমন কিছু জানি না। তবে খোঁজ নিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।’