পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার প্রধান নদের নাম আন্ধারমানিক নদ। এটি এখন মৃত্যু প্রায়। আন্ধারমানিক নামটি শুনে অনেকেই হয়তো বলবেন অন্ধকারে আবার মানিক হয় কী করে! অবাক হওয়ার মতো হলেও এ এলাকায় মানুষের জীবন যাত্রায় নদটি এক কালে ‘মানিক’ ছড়িয়েছে। নিজের বুকের পলি মাটি ও পানি দিয়ে ফলিয়েছে সোনালি ফসল। বুকে আগলে রাখছে সাদা সোনা খ্যাত রুপালি ইলিশ।
কিন্তু পৌর শহরের গুরুত্বপূর্ণ আন্দারমানিক এখন দখল ও বর্জ্যরে চাপে বিপর্যস্ত। কলাপাড়ায় এর পাড় জুড়ে ফেলে দেয়া ছেঁড়া কার্টন কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন বর্জ্যরে স্তূপ। ঝড়ঝঞ্ঝা আর বাতাসে সেগুলো গিয়ে মিশছে নদের বুকে। বিনষ্ট হচ্ছে আশপাশের পরিবেশ, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও ভরাট হচ্ছে তার বুক। বহমান নদের এমন পরিণতির জন্য তীরবর্তী ব্যবসায়ীদের দায়ী করছেন অনেকে। আবার সঙ্কট কাটাতে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় অভিযোগ উঠছে পরিবেশ অধিদফতরের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) তথ্য মতে, আন্ধারমানিক নদের পানি প্রবাহের দৈর্ঘ্য ৩৯ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ৩৩০ মিটার। এই নদীর গভীরতা ১৫ মিটার। এখন অবশ্য প্রতি বছর অন্তত পাঁচ ফুট করে কমে যাচ্ছে নদের প্রস্থ। নদটির দুই পাড়ে পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
আরো পড়ুন : ঈদকে ঘিরে সাজছে সমুদ্রকণ্যা কুয়াকাটা, চলছে সড়ক উন্নয়ন
সরেজমিন দেখা গেছে, মাছ বাজার, কাঁচা বাজার, কলাপট্টি, লঞ্চ ঘাট, হ্যালিপোর্ট, ব্রিজের প্রবেশ মুখ এলাকায় নদের তীরের অবস্থা একেবারেই বেহাল। হোটেল-রেস্তেরাঁর পচা ও উচ্ছিষ্ট খাবারসহ নানা ধরনের বর্জ্য নিয়মিত ফেলা হচ্ছে নদের পাড়ে। নদের তীরে ফেলা এসব বর্জ্য গড়িয়ে গড়িয়ে পানিতে পড়ছে। এসব ক্ষতিকর বর্জ্য প্রকাশ্যে ফেলা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিশেষ করে নদের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ব্যবসা প্রতিতষ্ঠান গুলোর কারণেই এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নদটি।
কাঁচা বাজারে নদীর পাড়েই হোটেল দোকান। এর চারপাশে স্তূপ হয়ে আছে নানা রকমের বর্জ্য। ভাগাড়ের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন, কাগজের কার্টন, ডাবের খোসাসহ নানা ধরনের ফেলনা সামগ্রী। শুধু কাঁচা বাজারই না, নদের পাড় ঘেঁষে থাকা অধিকাংশ মুদি ও স্টেশনারি দোকান, ওয়ার্কশপ, মিল-কারখানাগুলোর ময়লা-আবর্জনাও ফেলা হচ্ছে পাড়ে। বহুতল ভবনসহ টিনশেড স্থাপনা তোলা হয়েছে আন্ধারমানিকের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। সবচেয়ে বেশি স্থাপনা তোলা হয়েছে আন্ধারমানিকের উত্তর পাড়ে। নদের পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা অন্তত ১০টি ইটভাটার ময়লাও ফেলা হচ্ছে আন্দারমানিকের বুকে।
পৌরশহর এলাকার নাচনাপাড়া ফেরিঘাট থেকে ফিশারি পর্যন্ত আন্ধারমানিকের তীরসহ নদের পাড় দখল করে তোলা হয়েছে এসব স্থাপনা। আন্ধারমানিকের পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় ইতোমধ্যে অন্তত সাতটি সুইস সংযুক্ত খাল ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। পলি পড়ে এবং নতুন চর জেগে ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদের প্রায় ২৫ কিলোমিটারই স্থায়ীভাবে শুকিয়ে গেছে।
আন্ধারমানিকের পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় শহরের মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত চিংগড়িয়া খালটির অস্তিত্বও আজ বিপন্ন প্রায়। এ কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় পৌর এলাকায়। এ ছাড়া কচুপাত্রা নদীর প্রবেশ মুখে দেয়া হয়েছে বাঁধ। আর পাঙ্গাশিয়ার সংযোগ স্থলটিও ভরাট প্রায়।
আরো পড়ুন : আগুন থেকে নিজের জানমাল রক্ষায় সবাইকে সচেতন হতে হবে – ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী
পরিবেশকর্মী মেজবা উদ্দিন মান্নু বলেন, আমাদের এই নদ এক সময় সৌন্দর্যে ও রূপেগুণে পূর্ণ ছিল। সেই সৌন্দর্যে এখন জং ধরেছে। বিষয় গুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। সবাই সচেতন না হলে নদ ও নদের পাড়ের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
কলাপাড়ায় প্রবীণ সাংবাদিক শামসু আলম আক্ষেপ করে বলেন, ভয়াবহ নাব্যতা সঙ্কটে আন্ধারমানিক নদের অববাহিকায় নেমে এসেছে পরিবেশ বিপর্যয়। কৃষি আবাদেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। তাই দুই পাড়ের মানুষের প্রাণের দাবি অতি দ্রুত নদটিকে ড্রেজিং করে এর পানি প্রবাহ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হোক। আন্ধারমানিক আমাদের ঐতিহ্য। স্থানীয় সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত। এটি রক্ষা করতেই হবে। নদটি রক্ষার পাশাপাশি নদের চর পড়ে ভরাট অংশ যাতে কেউ দখল করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ারও যৌক্তিকতা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
আরো পড়ুন : পটুয়াখালীতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, পরিবেশ রক্ষার্থে আমি পৌরসভার সাথে আলাপ করে একটি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা করব।