পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: নভেম্বর থেকে জুন এই ৮ মাস জাটকা সংরক্ষণ মৌসুম। এ সময়ে জাটকা ধরা থেকে বিরত থাকার জন্য সরকারের তরফ থেকে নিবন্ধিত জেলেদের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল ৪ মাস প্রতিমাসে ৪০ কেজি হারে চাল সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়। চলতি বছর এ পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন এলাকায় জেলেদের মাঝে জাটকা সংরক্ষণ মৌসুমের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের সহায়তার চাল বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু চাল বিতরণে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তালিকা তৈরিতে রয়েছে সমন্বয়ের অভাব ও করা হয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা। এতে অধিকার বঞ্চিত হয়েছেন প্রকৃত জেলেরা।
জেলার গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি ইউনিয়নে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১৮৫৬ জন। চলতি জাটকা সংরক্ষণ মৌসুমে ভিজিএফ বরাদ্দ হয়েছে ৮০৮ জন জেলের নামে। এসব জেলেরা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মোট ৮০ কেজি করে চাল পাওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছেন ৪০ কেজি। আবার চালের তালিকায় নাম লেখাতে দিতে হয়েছে উৎকোচ। চাল পেয়েছেন সখ্যতার কারণে নিবন্ধনের আওতায় থাকা অন্যান্য পেশাজীবীরা। ভোট না দেয়ায় চাল বিতরণের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন প্রকৃত জেলেরা। তাই যাচাই বাছাই সাপেক্ষে নিবন্ধিত তালিকা হালনাগাদ করার দাবি প্রকৃত জেলেদের।
আরো পড়ুন : ১০ দিনে কলাপাড়ায় মৎস্য আড়তে ৪৭৫ টন ইলিশ বিক্রি
ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোঃ মোফাজ্জেল বলেন, আশেপাশের অনেক ইউনিয়নের জেলেরা ২ মাসে ৮০ কেজি চাউল পাইছে আমরা কেন পামু না? এই চেয়ারম্যান ক্ষমতায় আসার পর আমরা একবারও পুরা চাউল পাইনাই। যারা জেলে না, সাগর চোখে দেখে নাই, কোনদিন নদীতেও যায় নাই হেরাও চাউল পাইতে আছে। আমাগো চাউল ভাগ কইরা তাগো দেতে আছে।
মোঃ আলমিন মোল্লা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাগো নামে ৮০ কেজি করে চাউল আসছে কিন্তু সেই চাউল আমাগো দেয় না। অনেক ওয়ার্ডে কোন জেলে নাই কিন্তু তালিকা কইরা অন্য মানুষের নাম ঢুকাইয়া আমাগো চাউল কম দিয়া তাগো ভাগ কইরা দেয়। আমরা আমাগো ন্যায্য অধিকার চাই।
মোঃ বিল্লাল উদ্দিন নামের আরেক জেলে নিজের কার্ড দেখিয়ে বলেন, আমি আগে চাউল পাইতাম এই চেয়ারম্যান আওয়ার পরে তালিকা দিয়া আমার নাম কাইট্টা দেছে। যারা ভ্যান চালায়, দোকান দেয়, কৃষি কাজ করে তাগো চাউল দেয়। কিন্তু আমি জাইল্লাগিরি করলেও চাউল পাই না।
একই অভিযোগ ৪ নং ওয়ার্ডের কবির খাঁ, ২ নং ওয়ার্ডের আইয়ুব সরদারসহ অন্যান্য জেলেদের।
৪ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ মনিরুল ইসলাম শোভন বলেন, চেয়ারম্যান তার পছন্দের লোক দিয়া তালিকা করছে। আমি যে তালিকা করছি সে তালিকা সে নেয় নাই। আমার ওয়ার্ডে ১৪৬ জন নিবন্ধিত জেলে আছে এরমধ্যে ৮২ জনের নামের তালিকা করা হয়েছে। এই ৮২ জনের মধ্যেও ১৮ জন চাল পায় নাই। আমি স্লিপ দিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে পাঠালেও তিনি তাদের চাল দেননি। ৮০৮ জন জেলের নামে ৮০ কেজি হারে চাল বরাদ্দ এসেছে। এই চাল যাতে বেশি সংখ্যক মানুষ পায় তাই ভাগ করে দেয়া হয়েছে।
৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ দাদন মিয়া বলেন, আমি রানিং মেম্বার কিন্তু জেলেগো তালিকা করতে পারি নাই। তালিকা করে দলের নেতা কর্মীরা। তারা টাকা পয়সা নিয়া তাগো পছন্দের লোক জনের নাম তালিকায় ঢুকাইছে। যাগো চাউলডা প্রয়োজন তারা না পাইয়া পাইছে অন্যরা। তাছাড়া তালিকায় অনেকের নাম আছে যারা এখন এদেশে থাকেনা। তাগো নামের চাউল নিল কেডা?
এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান সাহেবরে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমারে বলছেন এ ব্যাপারে আপনারে পরে বলবো।
আরো পড়ুন : আগুনে পুড়ে ছাই ঈদের আনন্দ
দাদন মিয়া আরো বলেন, বরাদ্দ আসছে ৮০৮ নামে কয়েকজন মেম্বারের জোগসাজেসে চাউল বিতরণের তালিকা করা হয়েছে ১৬১৬ জনের। এই কারণে জেলেদের নিবন্ধনের তালিকায় থাকা মোটরসাইকেল ড্রাইভার, ভ্যান ড্রাইভার, দোকানদার, ফার্মেসিওয়ালারা চাউল পাইছে।
একই অভিযোগ ৮ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ স্বপনের। তিনি বলেন চেয়ারম্যান সাহেব জেলেগো চাউল ভাগ কইরা দেওয়ায় তারা ক্ষিপ্ত হইয়া আমার কাছে আসে। যারা পাওয়ার যোগ্য তারা চাউল না পাইয়া যখন জবাব চায় আমরা কি জবাব দিতে পারি? এবিষয়ে তারে বারবার বলা স্বত্ত্বেও কোন সুরাহা হয়নি।
২ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ কামাল হোসেন বলেন, ২০০৭/২০০৮ সালে যখন ঢালাও ভাবে জেলেদের নিবন্ধন হয়েছে তখন অনেকের নাম ঢুকছে যাদের অনেকে এখন পেশা পরিবর্তন করছে। এমন ব্যাপক নাম প্রায় সব ইউনিয়নেই আছে। এদের দেখেই সবাই অনুযোগ করে যে ভ্যান চালক অটো চালকেরা চাউল পায়। তবে বরাদ্দ কম প্রকৃত জেলেদের বাদ দিয়ে কেন এসব ভ্যান চালক অটো চালকদের চাল দেয়া হয়েছে এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি তিনি।
ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ মাসুদ রানা বলেন, উপজেলা সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্তের আলোকে সরকারের বরাদ্দকৃত সুবিধা অধিক সংখ্যক জেলেদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, ট্যাগ অফিসার এবং আমি মিলে তালিকা অনুমোদন দিয়েছি।
তালিকায় স্বজনপ্রীতিসহ অন্যান্য পেশাজীবীদের নাম থাকা ও অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন জবাব দিতে পারেননি তিনি।
গলাচিপা উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ জহুরুন্নবী বলেন, গলাচিপা উপজেলায় মোট ২০ হাজার ৮৩৫ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে ৯০০০ নামে ২ মাসের চালের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বেশি সংখ্যক জেলে বাদ পরার বিষয়টি উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা স্থানীয় সংসদ সদস্য এস.এম শাহাজাদার উপস্থিতিতে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরা উত্থাপন করেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সরকারের এ বরাদ্দকৃত চাল অধিক সংখ্যক জেলেদের মাঝে বণ্টনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে যে জেলে এক মাসের চাল পেয়েছেন তাকে অন্য মাসে বাদ রেখে অন্যদেরকে চাল দেয়া হয়েছে।
তালিকা হালনাগাদের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০২১ সালে জেলেদের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে আবারো এ তালিকা হালনাগাদ করা হবে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
এ বিষয়ে গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মহিউদ্দিন আল হেলাল তালিকা তৈরি ও বিতরণ ব্যাবস্থাপনায় কিছু সমস্যা থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, সরকার শ্রেণি অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে চাল বরাদ্দ দেয়। কিন্তু চাল বিতরণের সময় জেলেদের আলাদা শ্রেণি বিভাগ করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে বরাদ্দের চেয়ে বেশি জেলেদের মাঝে চাল বিতরণ করতে হয় তাই স্থানীয় সংসদ সদস্য সহ সকলের সাথে পরামর্শ করে এ কাজটি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, জেলে নয় এমন কিছু লোকের নাম তালিকায় আছে। পেশা পরিবর্তণের কারণে এমনটি হতে পারে। এজন্য আমরা আবেদন চাচ্ছি যারা জেলে নেয় আমরা বাতিল করব এবং যারা নতুন করে এ পেশার সাথে যুক্ত হয়েছে ওদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে।