বরিশাল অফিস :: দক্ষিণ বাংলার অক্সফোর্ড হিসেবে পরিচিত বরিশালের ঐতিহ্যবাহী, প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ। দক্ষিণবঙ্গের শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠটি ১৮৮৯ সালে মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রতিষ্ঠা করেন, তার বাবা ব্রজমোহন দত্তের নামে কলেজটির নামকরণ করেন। একসময় বরিশাল অঞ্চলের একমাত্র উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রস্থল ছিল এই কলেজটি। বরিশালের প্রাচীনতম এই কলেজটিতে পড়াশোনা করেছেন দেশবরেণ্য অসংখ্য গুণিজন। কলেজটির সুনাম, সুখ্যাতি রয়েছে দেশ জুড়ে। ইতিহাস ঐতিহ্য ও গৌরবের ১৩৪ পেরিয়ে কলেজটি পা দিয়েছে ১৩৫ বছরে। শর্তবষী কলেজটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন, অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, তরুণ লেখক মো. মেহেরাব হোসেন রিফাত
‘ব্রজমোহন কলেজের গৌরব পুনরুদ্ধারে আমাদের অঙ্গীকার’ ::
ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল- যে নামটি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, বরং বরিশাল শহরের জন্য এক গর্বের প্রতীক। এ কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসে এখানকার জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েছে। তবে গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি, এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান ধীরে ধীরে অবনতি হয়েছে, যা একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার এবং অনেকের কাছেই গভীর উদ্বেগের বিষয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যতম মূলভিত্তি হলো তার শিক্ষকরা। ব্রজমোহন কলেজের অনেক শিক্ষকই অত্যন্ত যোগ্য এবং অভিজ্ঞ। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, কিছু শিক্ষকের পাঠদানের পদ্ধতি অত্যন্ত পুরোনো এবং কার্যকারিতা হারিয়েছে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, কিন্তু আমাদের কলেজে এই দিকটি যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না। ল্যাবরেটরি এবং লাইব্রেরির ব্যবহারে নতুনত্বের অভাবও শিক্ষার মানকে প্রভাবিত করছে। প্রশাসনিক কাঠামোর জটিলতা এবং দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সময়মতো ক্লাস না হওয়া, পরীক্ষার সময়সূচি পরিবর্তন এবং ফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা শিক্ষার্থীদের মনোবল হ্রাস করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না, যার ফলে শিক্ষার্থীরা হতাশা এবং বিভ্রান্তির মধ্যে থাকে। সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম এবং ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রমেও মন্দা দেখা যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শুধু অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমই নয়, বরং ছাত্রছাত্রীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশের জন্য সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গত কয়েক বছরে এ ধরনের কার্যক্রমের সংখ্যা এবং মান কমে গেছে, যা শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের অভাব সৃষ্টি করছে। তবে সবকিছুর পরও, ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখনো উচ্চমানের শিক্ষার জন্য একটি গভীর আগ্রহ এবং প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আমি আশা করি, কলেজের প্রশাসন এবং শিক্ষকরা আমাদের এই চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করবেন। শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন এবং মানসিক বিকাশের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে পারি। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে স্মরণীয় এবং অর্থবহ করতে, আসুন আমরা আমাদের কলেজের উন্নতির জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকি।
রাইসুল ইসলাম শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
‘চন্দ্রদীপের প্রদীপ’ ::
আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে আঁধারে ঘেরা চন্দ্রদীপের মধ্যে প্রদীপ রূপে জ্বলে উঠেছিল এই ব্রজমোহন কলেজ। প্রদীপালোক পৌঁছে গেছে পদ্মার পাড় থেকে বঙ্গোপসাগর তীরে। তিন শতাব্দীর সেতুবন্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও জ্ঞান বিতরণ করে চলেছে এই ব্রজমোহন কলেজ। বহু শিক্ষার্থী এই ক্যাম্পাসে এসে হয়েছেন প্রতিষ্ঠিত। পেয়েছেন পরিচিতি ও সম্মান। তারা আমাদের গর্ব। আমাদের প্রেরণা ও আবেগ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারি ব্রজমোহন কলেজ তার গৌরব হারাতে বসেছে। হয়তো যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ় হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো সফলতার গল্প শোনা যায় না। প্রত্যাশা পূরণ করছে না এখন আর। বিসিএস পরীক্ষার সাফল্য প্রচার হচ্ছে না। এমনকি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে প্রথম হওয়া কলেজটি এখন টপ-থ্রিতেও জায়গা পায় না। ক্যাম্পাসে পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে না। বহিরাগত, অছাত্র এবং উচ্চমাধ্যমিকের শিশুশিক্ষার্থীদের চলাফেরা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। বিভিন্নভাবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ, ক্যানটিন উন্নয়ন, হল অব্যবস্থাপনা নিরসন, বাকসু নির্বাচন, প্রয়োজনীয় কর্মচারী নিয়োগ দেওয়াসহ ইত্যাদি বিষয়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করার অনুরোধ করছি। পরিশেষে বলতে চাই, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে, শিক্ষাবান্ধব স্মার্ট ক্যাম্পাস চাই।
বনি আমিন শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ
‘দৈন্যদশায় ভুগছে ব্রজমোহন কলেজ’ ::
দক্ষিণবঙ্গের আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিচিত, ইতিহাস ঐতিহ্যসমৃদ্ধ সরকারি ব্রজমোহন কলেজ। কথিত আছে, ভারতবর্ষ যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, বরিশাল তখন আলোকিত। মূলত শিক্ষার আলোতেই আলোকিত ছিল বরিশাল। সেই আলোর দীপশিখা জ্বেলেছে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত প্রতিষ্ঠিত ব্রজমোহন কলেজ। ইতিহাস ও ঐতিহ্যে আমাদের কলেজটি ছিল ঋদ্ধ। কিন্তু বর্তমান সময়ে কলেজটির মর্যাদা ও শ্রীবৃদ্ধি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। আমাদের এই শিক্ষাঙ্গন জাতীয় পর্যায়ে সর্বদাই শীর্ষ পাঁচে থাকত। কিন্তু বর্তমানে সেই স্থানটিও হারিয়ে ফেলছে। জাতীয় রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। বিখ্যাত অনেক ব্যক্তি আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন। তবে বর্তমান সময়ে ব্রজমোহন কলেজ তার অতীত জৌলুস হারিয়ে হয়তো বার্ধক্যে উপনীত হচ্ছে। কলেজের কিছু ডিপার্টমেন্টে রয়েছে শিক্ষকস্বল্পতা, প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত ছাত্রাবাস; আবার ক্যাম্পাসে সৌন্দর্য রক্ষার্থে দেখা যায় কলেজ প্রশাসনের চরম উদাসীনতা। রাজনৈতিক অনৈক্য ও অস্থিরতা সমানতালে বিরাজমান। এ ছাড়া এই কলেজে একসময় বিশটিরও বেশি সামাজিক সংগঠন ছিল যেগুলো বিভিন্ন উৎসব, পার্বণে বা সংকটে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখত। কিন্তু ক্রমান্বয়ে সামাজিক সংগঠনগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। আবাসিক ছাত্ররা কায়ক্লেশে ও টানাপড়েন জীবন-সংগ্রাম চালাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা তিনবেলা যে খাবার খাচ্ছে তাতে নেই চাহিদামতো পুষ্টি উপাদান। কলেজ প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপই পারে কলেজের দৈন্যদশা থেকে অতীত ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে। তাই আমি সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে কলেজ প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
জাহিদুল ইসলাম পলাশ শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ