সংকট উত্তরনে বরিশালে দীর্ঘ মেয়াদী কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তাগিদ
বরিশাল অফিস :: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘প্রাচ্যের ভেনিস’বরিশাল নগরীর ভঙ্গুর পয়.নিষ্কাশন ব্যবস্থা বার বারই মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। ‘ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল’এ জলাবদ্ধতাকে নিত্যসঙ্গী করেই চলতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
বরিশাল নগরীতে এ দৃশ্য পুুরনো হলেও তা থেকে উত্তরনে জোরালো কোন পদক্ষেপ নেই। এমনকি নগরীর পাশের বহমান কীর্তনখোলা নদীর পাড়ের নৌ বন্দরের নাব্যতা রক্ষায় প্রতিবছরই শুষ্ক মৌসুমে পলি অপসারন করে তা নদীতেই ফেলায় নগরীর অভ্যন্তরের খালগুলো মুখ ক্রমাগত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে এ বরিশাল নগরীর পানি সুষ্ঠভাবে নদীতে পড়ছে না। বরিশাল নগরীর অনেক এলাকাতেই জলাবদ্ধতা এখন ১২ মাসের সঙ্গী। বিষয়টি নিয়ে আজ পর্যন্ত বরিশাল সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিএ’র সাথে কোন বৈঠক বা আলাপ আলোচনা পর্যন্ত করেনি।
তবে দেশের সব সিটি করপোরেশনের মত বরিশাল সিটি করপোরেশনেও প্রশাসক নিয়োগের পরে সোমবারই বিভাগীয় কমিশনার কাজে যোগদানের দিনই জলাবদ্ধতার বিপত্তি তার জন্যও ছিল বিব্রতকর। অতিরিক্ত এ দায়িত্ব গ্রহন করেই বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. শওকত আলী নগর ভবনে বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছাড়াও সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের এক সভায় চলমান সব উন্নয়নমূলক কাজ ছাড়াও পয়.নিস্কাশন সহ সেবামূলক কার্যক্রমে বিশেষ গুরুত্বারোপের ঘোষনা দিয়েছেন।
১৮৬৯ সালে গঠিত বরিশাল টাউন কমিটি ১৮৭৬ সালে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার জনসংখ্যা সম্বলিত ৭ বর্গমাইল এলাকার দুটি ওয়ার্ড নিয়ে বৃটিশ-ইন্ডিয়ার ‘মিউনিসিপালিটি অ্যাক্ট’ অনুযায়ী ‘বরিশাল মিউনিসিপালিটি’ গঠন করা হয়েছিল। সে সময়ে এ শহরে সরকারী খাস খতিয়ানভুক্ত অর্ধ শতাধিক খালের অস্তিত্ব থাকলেও নানা মহলের দখল প্রক্রিয়ায় এখন তার অর্ধেকও খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা।
২০০৩ সালে প্রায় ৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশন গঠিত হবার পরে বেশ কিছু খালে অরসিসি স্লাব সহ পাকা ড্রেনে রূপান্তর হলেও পয়.নিস্কাশন ব্যবস্থা অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ১০ ফুট গভীর ও ১০ ফুট প্রশস্ত এসব খালের তীরের বাসিন্দাদের বিবেকহীন কর্মকান্ডের পাশাপাশি নগর ভবন থেকে নিয়মিত ও যথাযথ পরিস্কার না করায় পাকা ড্রেনগুলোর তলদেশ থেকে প্রায় উপরিস্তর পর্যন্ত ভরাট হয়ে গেছে। ফলে ঘন্টায় ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই এ নগরী সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। এমনকি গত প্রায় এক দশক পর্যন্ত মাঝারী বৃষ্টিতেও নগরীর নবগ্রাম রোডের বটতলা বাজারের পশ্চিম পাশ থেকে হাতেম আলী কলেজের পূর্ব পাশের ১ কিলোমিটার এলাকা বৃষ্টির পানিতে থৈ থৈ করছে। বছর জুড়েই এ অংশে ড্রেনের পানি রাস্তা ছুই ছুই করে। অভিযোগ রয়েছে, রাস্তার এ অংশের ড্রেনের অভ্যন্তরে বিপুল পরিমান ইট-বালু ও খোয়া সহ মাটির আস্তরনে ড্রেনের কোন অস্তিত্বই নেই।
গত দশ বছরেরও বেশী সময় ধরে এ নগরীর খালগুলো খননে কোন প্রকল্প অনুমোদন করেনি পরিকল্পনা কমিশন। ২০১৪-১৫ সালে তৎকালীন নগর পরিষদ ২২টি খাল সংস্কার, উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বর্ধনের লক্ষ্যে প্রায় সোয়া ২শ’ কোটি টাকার একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তবনা-ডিপিপি’ দাখিল করলেও তা অনুমোদন লাভ করেনি। এরইমধ্যে ২০১৮ সালের শেষভাগে বিগত নগর পরিষদ পূর্বের প্রকল্প বাদ দিয়ে প্রায় সাড়ে ১১শ কোটি টাকার একটি ভিন্ন ডিপিপি দাখিল করে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে ‘পরমার্শক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা রিপোর্ট সহ প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে ডিপিপি’টি পুনর্গঠন’র দিক নির্দেশনা দিয়ে তা ফেরত দেয়া হয় । কিন্তু নগর ভবন থেকে পরামর্শকের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার একটি সংশোধিত ডিপিপি দাখিল করলেও মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন না করে ছোট আকারের প্রকল্প-প্রস্তাবনা পেশ করার নির্দেশনা দেয়। ফলে সে প্রকল্প আর অনুমোদিত হয়নি। তবে বর্তমান নগর পরিষদের সদ্য বিদায়ী মেয়রের সময়ে নগরীর একাধিক খাল খনন ও সংস্কারে প্রায় সাড়ে ৯শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প-প্রস্তাবনা প্রী-একনেক-এর অনুমোদনের পরে একনেক’এর চুড়ান্ত অনুমোদন পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল বাশার জানিয়েছেন, নগরীর সবগুলো খাল সংস্কার ও উন্নয়ন সহ দৃষ্টিনন্দন করার লক্ষ্যে আমরা প্রায় সাড়ে ৯শ’ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ একটি প্রস্তাবনা পেশ করেছি।
অপরদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সরকারী তহবিলে প্রায় সোয়া ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর ৭টি খাল সংস্কার করা হলেও দুইপাশের জমি দখলের কারণে সে কাজও নির্বিঘ্ন সম্পন্ন করা যয়নি বলে জানা গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রায় ৪ বছর আগে ১০.৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মহানগরীর পলাশপুর খাল, আমানতগঞ্জ খাল, জেল খাল, ভাটার খাল, চাঁদমারী খাল, সাগরদী খাল ও রূপাতলী খালগুলোর প্রায় ১৮ কিলোমিটার অংশ সংস্কার সহ এর দু পাশে ওয়াকওয়ে ও সৌন্দর্য বর্ধনের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প হাতে নিলেও বিগত নগর পরিষদের বাঁধার মুখে তা আটকে ছিল। তবে বর্তমান নগর পরিষদ দায়িত্ব গ্রহনের পরে এ বছরের শুরুতে কাজ শুরু হলেও ৩০ জুনের মধ্যে তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করতে গিয়ে মাত্র সাড়ে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬ কিলোমিটোর খাল সংস্কার সম্ভব হয়। তবে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ সহ খালগুলোর পাশের জমি বেদখল হয়ে যাওয়ায় দু পাশের ওয়াকওয়ে ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করা যায়নি বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। এমনকি কয়েকটি খালের পাশের জমি বেদখর থাকায় তা সুষ্ঠুভাবে খননও সম্ভব হয়নি।
বরিশাল নগর পরিকল্পনাবীদগন লাগাতর জলাবদ্ধতার দূর্ভোগ থেকে রক্ষায় বরিশাল মহানগরীর জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে সিটি করপেরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, জনস্বার্থে সব কিছুই করা হবে। নতুন প্রশাসক জনস্বার্থে কাজ করতে নগর ভবনের সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা জনস্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়েই সম্ভব সবকিছু করছি।
বৃষ্টিপাতের প্রবনতা হ্রাসের সাথে ফুসে ওঠা সাগর অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করায় বরিশাল অঞ্চলের নদ-নদীগুলোর পানি বিপতসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বরিশাল সহ সন্নিহিত উপকূলীয় এলাকায় প্লাবন পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হলেও দৌলতখান সহ কয়েকটি এলাকায় মেঘনা, সুরমা ও তেতুলিয়ায় এখনো পানি বিপদ সীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে।
উজান থেকে সাগরমুখি প্রবাহের প্রায় ৭০ ভাগ পানিই মেঘনা নদী বহন করে সাগরে নিয়ে যাচ্ছে। ভাদ্রের পূর্ণিমার ভরা কাটাল কেটে যাওয়ায় ফুসে ওঠা সাগর প্রায় স্বাভাবিকের কাছে নেমে আসায় উজানের পানি গ্রহন করতে শুরু করেছে। ফলে আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই উজানের বণ্যা পরিস্থিতিরও উন্নতি আশা করছেন পানি বিশেষজ্ঞগন।
শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বরিশালে প্রায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যা আগের ২৪ ঘন্টায় ছিল প্রায় ৭০ মিলিমিটার। বরিশাল কৃষি অঞ্চলে রোপা আমনের প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর জমি ক্রমে প্লাবনমূক্ত হতে শুরু করেছে। মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকেও পানি নামতে শুরু করেছে। তবে ভঙ্গুর পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার কারনে নগরীর বেশীরভাগ ড্রেন এখনো আটকে থাকায় পরিস্থিতির উন্নতি বিলম্বিত হচ্ছে। বিশেষকরে নবগ্রাম রোডের একটি বড় এলাকার ড্রেনে ময়লা আবর্জনা আটকে থাকায় নগরীর পশ্চিম অংশের পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা চরম বিপর্যয়ের কবলে।
বরিশাল সহ উপকূলীয় এলাকার নদী বন্দরগুরোকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। মৌসুমী বায়ু বরিশাল সহ সন্নিহিত এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। যা বরিশাল সন্নিহিত উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারী অবস্থায় রয়েছে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।