চন্দ্রদ্বীপ নিউজ :: তরুণদের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিদেশি বন্ধুদের সহযোগিতা চেয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার এক রক্তস্নাত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যে ছাত্ররা জীবন দিয়েছে। তরুণদের আত্মত্যাগ আমাদের সামনে বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা এই সুযোগ হারাতে চাই না। নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেছেন, সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য ও ভোটার তালিকা প্রস্তুত হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এর সমাধান না হলে সমগ্র অঞ্চল সমস্যায় পড়বে।
গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বিভিন্ন সাইড ইভেন্টে অংশ নিয়ে এবং বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠকে এসব কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান। অন্যদিকে মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ড. ইউনূস ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠকের পর হোয়াইট
হাউস এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন দুই সরকারের মধ্যে আরও সম্পৃক্ততাকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বাংলাদেশকে তার নতুন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে মার্কিন সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. ইউনূসকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্যপদ প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশি বন্ধুদের উদ্দেশ করে বলেন, যুবসমাজের জীবন উৎসর্গ ও অদম্য নেতৃত্বের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে। একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যে তারা জীবন দিয়েছে। তরুণদের আত্মত্যাগ আমাদের সামনে বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা এই সুযোগ হারাতে চাই না। বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে তরুণরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায়। এটি বাস্তবায়নে আপনাদের সবার সমর্থন প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে। সংবর্ধনা আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আরও ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আবদুল মুহিত, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রমুখ।
ড. ইউনূসের সঙ্গে আলোকচিত্রী ও লেখক শহিদুল আলম শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনাগুলো নিয়ে লেখা দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, গোটা জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। যারা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, আমরা তাদের হতাশ করতে চাই না। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার সরকার কাজ করছে। তিনি বলেন, যুবসমাজের সামনে কোনো স্বপ্ন ছিল না। স্বৈরাচার তাদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। তাই তারা স্বেরাচারের পতন ঘটাতে বুলেটের সামনে দাঁড়াতে পিছপা হয়নি। বিদেশি বন্ধুদের উদ্দেশে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের তরুণরা যে সাহস ও প্রত্যয় দেখিয়েছে, তা আমাদের অভিভূত করেছে। বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে তারা পঙ্গুত্ববরণ করতে পিছপা হয়নি। তিনি বলেন, তরুণদের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ গড়তে আমরা আপনাদের পাশে চাই।
এর আগে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অধিবেশনের ফাঁকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় তিনি বলেন, বর্তমান বাংলাদেশ একটি নতুন দেশ। নতুন সরকার গঠনের পর নির্বাচন, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতিবিরোধী এবং সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করা হলে এবং ভোটার তালিকা তৈরি হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে।
আইএমএফের প্রধান নির্বাহী ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা এই উদ্যোগে ড. ইউনূসের প্রতি সমর্থন জানান। ঋণদাতা সংস্থা এই সরকারের জন্য আর্থিক সহায়তার বিষয়টি দ্রুত ‘ট্র্যাক করবে’ জানিয়ে জর্জিয়েভা বলেন, তিনি বাংলাদেশে আইএমএফের একটি দল পাঠিয়েছেন এবং দলটি এখন ঢাকায় রয়েছে। তিনি বলেন, আইএমএফ বোর্ড দলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ঋণদান কর্মসূচি শুরু করতে পারে অথবা গত বছরের শুরুর দিকে চালু হওয়া বিদ্যমান সহায়তা কর্মসূচির আওতায় আরও ঋণ দিতে পারে। এ সময় বাংলাদেশকে ‘পরিবর্তিত দেশ’ বলে অভিহিত করেন জর্জিয়েভা। তিনি বর্তমান বাংলাদেশকে ‘বাংলাদেশ ২.০’ আখ্যা দিয়ে দেশের সংস্কারের উদ্যোগকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন।
অন্যদিকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমাদের সতর্ক হতে হবে, এই সংকটের সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চল সমস্যায় পড়বে। আমাদের অব্যশই এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, আইসিসি প্রসিকিউটর করিম এ এ খান, আইওএম মহাপরিচালক অ্যামি পোপ প্রমুখ বক্তব্য দেন।
প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন করে ভাবার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আমরা চাই, জাতিসংঘ মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সকল পক্ষের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করুন। এ সম্মেলনে সংকটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনাপূর্বক নতুন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমাধানের উপায় কী হতে পারে, তেমন প্রস্তাব আসতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ যৌথভাবে পরিচালিত ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান’ কার্যক্রমে নতুন করে প্রাণশক্তি যোগ করা প্রয়োজন। যেহেতু এখন রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করার মতো তহবিলের অভাব রয়েছে, তাই রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরও জোরদার করতে হবে। তৃতীয় প্রস্তাবে ড. ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আন্তরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দ্বারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে ড. ইউনুসের উপস্থিতি ও তার দৃষ্টিভঙ্গি এবারের আলোচনাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
এদিকে গতকাল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, বৈঠকে দুই নেতা বিভিন্ন পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ড. মুহাম্মদ সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে পাকিস্তানের সমর্থন চেয়েছেন। শাহবাজ শরিফ এ উদ্যোগের জন্য তার সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন।
শাহবাজ শরিফ বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায় খোলা উচিত। আমাদের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা খুবই জরুরি।
অন্যদিকে বুধবার জাতিসংঘের সদর দপ্তরে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন এবং প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানান। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেন তিনি। এ ছাড়া বুধবার দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস সদর দপ্তর পরিদর্শনকালে ড. ইউনূস প্রখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী, প্রাইমাটোলজিস্ট এবং নৃতত্ত্ববিদ জেন গুডালকে দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ বইটি উপহার দেন। স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আয়োজিত একটি সংবর্ধনায়ও যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে ড. ইউনূসের।
ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। গতকাল স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় এ বৈঠক হয়। এ সময় ফলকার টুর্ক দেশ সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগের জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে অভিবাদন জানান। বৈঠকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক ানিত বোধ করছি। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে ড. ইউনুসের উপস্থিতি ও তার দৃষ্টিভঙ্গি এবারের আলোচনাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।