পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: পটুয়াখালীর পর্যটন নগরী কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে প্রবেশদ্বার হয়ে ওঠেছে পর্যটকের ভোগান্তির কেন্দ্র। সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটি কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের শৃংখলা রক্ষায় তদারকি না থাকায় প্রতিনিয়ত পর্যটকদের হয়রানি-আক্ষেপ বাড়ছে। নানামুখী ভোগান্তিতে কুয়াকাটা ভ্রমণে আগ্রহ হাড়াচ্ছেন পর্যটকরা। এতে করে পর্যটনখাতে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছে সচেতন মহল।
গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রেরও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। গত ২ মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও কুয়াকাটায় প্রশাসনিক কার্যক্রমের গতি ফেরেনি। প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ায় সমুদ্র সৈকত এলাকা এখন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। পর্যটকের ভোগান্তি নিরসনে কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই। দায়ীত্বশীল কোনো মহলেরই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। চলছে যত্রতত্র স্থাপনা বসানোসহ সংরক্ষিত পয়েন্টে বিভিন্ন যানবাহনের ছড়াছড়ি। প্রশানের নীরব ভূমিকা দেখে হতবাক পর্যটকরা। এতে কুয়াকাটা সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্বশীলতা নিয়ে পর্যটক ও স্থানীয়দের মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছে।
ঢাকা থেকে আগত পর্যটক মুহিদুল ইসলাম আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘যে প্রত্যাশা নিয়ে কুয়াকাটা ভ্রমণে এসেছিলাম সেই অনুপাতে সেবার মান আমরা পাচ্ছি না। রাতের সৈকতে লাইটিং ব্যবস্থা নেই, নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন জোড়ালো দেখছি না। পুরা বিশৃঙ্খল অবস্থা। দোকানদার থেকে শুরু করে অন্যান্য বিষয়ে নামমাত্র তদারকির সংস্থা থাকলেও বাস্তব চিত্র আদৌ ভালো দেখছি না। সৈকতে যাতায়াতে যে অবকাঠামো তা থেকে আমরা সেবা বঞ্চিত। সৈকতে যতটুকু মনোরম পরিবেশ রয়েছে তা রক্ষাণাবেক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেই। সৈকতে যে যার মতো করে রকমারির ব্যবসায় লিপ্ত আছে।’
মুহিদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ছাতা-বেঞ্চির সামনে আমরা আর কোনো পর্যটন এলাকায় ব্যবসা রিচালনা করতে দেখিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, এই সৈকতে হরহামেশা ভাসমান দোকানীদের অবস্থানের কারণে মূল সৈকত বাজারে পরিণত হয়েছে। সৈকতে নামতে যে সড়কটি রয়েছে তা ভাসমান দোকানীদের দখলে। জোয়ারের সময় যেটুকু ওয়াকিং জোন থাকে তাতেও ভাসমান দোকানীদের কারণে চলাফেরা করা যায় না।’
যানবাহন চলাচলে মানা হচ্ছে না কোনো শৃঙ্খলা
যানবাহন চলাচলে মানা হচ্ছে না কোনো শৃঙ্খলা
সরেজমিনে কুয়াকাটা সৈকতের মূল কেন্দ্রে যেকোনো প্রকার যানবাহন প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় সৈকতে বসানো জিও ব্যাগের ওপর দিয়েই মোটরসাইকেল ওঠানামা করছে। এতে সৈকত সুরক্ষার কাজে ব্যবহৃত সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রটেকশন বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তাছাড়া যানবাহনের অবাধ চলাচলে নারী-শিশু ও বয়োবৃদ্ধ পর্যটকেরা প্রতিনিয়ত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। অপরদিকে সৈকতে জিরো পয়েন্টের দুই দিকে বসানো ছাতা বেঞ্চীর সামনে থাকা ভ্রাম্যমাণ দোকানীদের উৎপাত যেন প্রকৃতি উপভোগের ক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা। যে যার মতো বিশৃঙ্খলভাবে বেচা-বিক্রি করলেও শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনের কোনো মাথাব্যাথা নেই। এছাড়াও একই জায়গায় জেলেদের জাল, নৌকা রাখাসহ করা হচ্ছে মাছের কারবার। জেলেদের ফেলে দেওয়া মাছের পঁচা দুর্গন্ধে ভোগান্তি পোহাতে হয় পর্যটকদের।
এদিকে সৈকতঘেষা সৌন্দর্যমণ্ডিত ব্লকের ওপর বসানো হয়েছে অস্বাস্থকর পরিবেশে জেলেদের ছোট ছোট টিনশেডের ঝুঁপড়ি ঘর। দীর্ঘ এলাকাজুড়ে জেলেরা ফেলে রাখেছেন অব্যবহৃত জালের স্তূপ এবং সমুদ্রে ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ (গেরাফী) বাকানো রড। জিরো পয়েন্টে পা ফেলতেই পর্যটকের ভোগান্তির শুরু হয়। সমুদ্র সৈকতে প্রবেশের নেই কোনো সড়কের ব্যবস্থা। সৈকতে ক্ষুদ্র ও ভাসমান ব্যবসায়ীদের দোকানপাট দিয়ে চলাচলের সামান্য জায়গা দখল করে রেখেছে। যা একটি অন্যতম পর্যটন নগরীর সৌন্দর্য, পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সৈকতে নামতে প্রধান সড়কের দুই পাশে কোনো প্রকার দোকানপাট বসানোয় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও যে যার মতো করে প্রভাব খাটিয়ে পলিথিন-ত্রিপাল দিয়ে ঝুঁপড়ি ঘর বসিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে। অনেকেই আবার সড়কের ওপরেই পরিচালনা করছে ব্যবসা বাণিজ্য। এতে করে সড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয় পর্যটক ও স্থানীয়দের।
এসব বিষয়ে কথা হয় কুয়াকাটা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন আমীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটি নামে থাকলেও একটি পর্যটন কেন্দ্র তদারকিতে যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় কাউকে এই কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে না রাখায় সমুদ্র সৈকতে এমন অব্যাবস্থাপনা তৈরি হয়েছে। সম্ভাবনার এই পর্যটন কেন্দ্র যেমন বেহাল অবস্থায় পরে আছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির উদ্যোগে তিন মাস, ছয় মাসান্তর একটি মিটিং ডাকা হয়, সেই মিটিং ও আলোচনার মধ্যে এই কমিটির কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। এক কথায় অভিভাবকবিহীন কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র।
সংশ্লীষ্টদের প্রতি দাবি, স্থানীয় যারা এই সৈকতের সঙ্গে জড়িত তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে যাতে এই কমিটি পুনর্গঠন করা হয়।
কুয়াকাটা সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম জানান, দেশের অন্যতম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা পর্যটন নগরীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রশাসন বদ্ধ পরিকর। ভাসমান ব্যবসায়ীদের জন্য একটি স্থায়ী মার্কেট করার পরিকল্পনা রয়েছে। পর্যটন সংশ্লিষ্ট সকল স্টক হোল্ডারদেরকে নিবন্ধনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলমান। এটি সম্পন্ন হলে একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরবে। এছাড়া রাতে সৈকতে লাইটিং ব্যবস্থার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।
কুয়াকাটায় পর্যটকের সেবার মান নিশ্চিতে এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ ফিরিয়ে আনতে সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটি নিরলস কাজ করে যাচ্ছে জানিয়েছে তিনি বলেন, ‘বিশেষত একটি আধুনিক সৈকতে রূপ দিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জিরো পয়েন্ট থেকে পূর্বে মেরিন ড্রাইভের আদলে একটি নান্দনিক সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। যার কাজ ইতোমধ্যে ৭০ ভাগ হয়েছে; এটি সম্পন্ন হলে সৈকতের সৌন্দর্য ফুটে উঠবে। এছাড়াও পর্যটকের বিনোদনের ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে নানা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।’
ইউএনও মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘অচিরেই পর্যটকরা কুয়াকাটা ভ্রমনে এসে আর ভোগান্তিতে পড়বে না বলে আমরা আশা করছি।’