বরিশাল অফিস :: বরিশালের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন ও পর্যটন এলাকা দুর্গা সাগর দীঘি। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের এই পর্যটন স্পটে এখনো নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়নি দর্শনার্থীদের জন্য। শুধু যে বখাটেদের উৎপাত এখানে তা কিন্তু নয়। সবচেয়ে বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে এখানে দুর্গা সাগর দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। রোগী সেজে বিনা টিকিটে প্রবেশ করা ছাড়াও ভিতরে বেড়েছে ভিক্ষাবৃত্তি। নেই দূর-দূরান্ত থেকে আগত দর্শনার্থীর জন্য কোনোরকম সেবামূলক ব্যবস্থা।
খাবার, বিশ্রাম, গাড়ি পার্কিংসহ পরিচ্ছন্ন টয়লেট সুবিধাও অনুন্নত। ভিতরে চমৎকার একটি মিনি চিড়িয়াখানা করা হলেও শিশুদের বিনোদনের জন্য রাখা হয়নি কোনো উপকরণ। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছয়টি চমৎকার হংশমুখো বোট দেয়া হলেও তা প্যাকেটবন্দী হয়ে পড়ে আছে পুকুর ঘাটে। এর পরিবর্তে প্লাস্টিকের দুটো সাধারণ বোট ভাসছে দীঘিতে। এগুলো স্থানীয় বখাটেদের নিয়ন্ত্রণে। এসব নিয়ে একাধিক অভিযোগ জানালেন ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও ঢাকা থেকে আগত কয়েকজন দর্শক।
সরেজমিনে ১৪ অক্টোবর বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নে অবস্থিত ইতিহাস ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন দুর্গা সাগর দীঘির প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে এসব অভিযোগ শুনতে হলো। তাদের অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেল ভিতরে প্রবেশ মাত্রই। এসময় বেশ কয়েকজন তরুনকে দেখা গেল মোটরসাইকেল নিয়ে দিঘির পাড়ের সরু সড়কে ছুটে বেড়াতে। যাদের দেখে দিঘি পাড়ে বসা মেয়েরা দ্রুত উঠে বের হয়ে গেল।
এই ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের দুর্গা সাগর দীঘি দেখার জন্য বরিশাল থেকে এসে প্রথমেই চোখে পড়বে প্রথম প্রবেশদ্বারে লেখা আছে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত গেট। ভুল করে এখানে নেমে পড়লে কিন্তু হাঁটতে হবে পুরো দেড় কিলোমিটার পথ। কারণ, এই প্রবেশদ্বারটি জন্মলগ্ন থেকেই তালাবদ্ধ থাকে। শুধু মাত্র প্রশাসনের প্রয়োজনেই খোলা হয় বলে জানালেন আশেপাশের বাসিন্দারা। দীঘি পাড়ের মূল প্রবেশদ্বারটিতে তখনও মেরামত কাজ চলছে। টিকিট কাউন্টারে বসা লোকটি ২০ টাকা দরে সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ৭৮টি টিকিট বিক্রি করতে পেরেছেন।
বিকেল তিনটার পর মোটামুটি ভীড় হয় বলে জানালেন টিকিট কাউন্টারে থাকা ব্যক্তি। ভিতরে প্রবেশ করে হাতের ডানেই রয়েছে মাটির তৈরি তৈজসপত্র নিয়ে দুটো বাণিজ্যিক পসরা। আর হাতের বামে ওয়াশরুম লেখা ভবনের পাশে দুটি সাইনবোর্ড দৃষ্টি কাড়ে। যেখানে লেখা এই দীঘির ইতিহাস। জানা যায়, স্থানীয় জনগণের পানি সংকট দূর করার জন্য ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে এ দীঘিটি খনন করা হয়। তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপ পরগনার রাজা শিব নারায়ন তার স্ত্রী রানী দুর্গাবতীর নামে এই দীঘি খনন করেন। জনশ্রুতি রয়েছে রাণী দুর্গাবতী একটানা বিশ্রামহীন যতদূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন ততদূর পর্যন্ত এ দীঘি খনন করা হয়েছে। আর এ কাজে তখনকার সময়ে তিন লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
চন্দ্রদ্বীপের রানী দুর্গাবতীর নামেই দীঘিটির নামকরণ করা হয় দুর্গা সাগর। দীঘি খননে একরাতে রাণী প্রায় ৬১ কানি জমি হেঁটেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী দীঘিটি ৪৫ একর ৪২ শতাংশ জমিতে অবস্থিত। এর ২৭ একর ৩৮ শতাংশ জলাশয় এবং ১৮ একর চার শতাংশ পাড়। এছাড়া দীঘির চারপাশ দিয়ে ১.৬ কিলোমিটার হাঁটার রাস্তা রয়েছে। পাড়টি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ১৪৯০ ফুট এবং প্রশস্ত পূর্ব-পশ্চিমে ১৩৬০ ফুট। দীঘিটির মাঝখানেই রয়েছে ছোট একটি দ্বীপ।
যা এ দীঘির সৌন্দর্য আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে তুলেছে। আর এখানেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঢাকা থেকে আগত দর্শক সাপ্তাহিক সময় পূর্বাপর পত্রিকার সম্পাদক ও গায়ক হাসান মাহমুদ বলেন, ঐ যে দ্বীপটি ওটিকে ঘিরেই হতে পারে এই দুর্গা সাগরের অন্যতম আকর্ষণ। পিকনিক স্পট যেটা পাড়ে তৈরি হয়েছে, সেটি ওখানে হতে পারে। পাশাপাশি ওখানে শিশুদের জন্য একটি বিনোদন ব্যবস্থা হলে খুবই চমৎকার হবে। তখন এই দীঘির আকর্ষণ আরও বৃদ্ধি পাবে। বোটগুলোও নিয়মিত ব্যবহার হবে এরফলে। তবে সবার আগে শক্তিশালী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে বলে জানান হাসান মাহমুদ।
ঢাকা থেকে স্ব-পরিবারে এই দুর্গা সাগর দীঘির পাড়ে এসেছেন কবি ও কণ্ঠশিল্পী হাসান মাহমুদ। তার সহধর্মিণী বললেন, এখানে পাড়ে ঘুরতে বেশ ভালো লেগেছে। চমৎকার সবুজের বেষ্টনী ও মিনি চিড়িয়াখানার পরিকল্পনা। চারপাশের পরিচ্ছন্নতাও খুবই সুন্দর। কিন্তু দূর-দূরান্ত থেকে আসা আমাদের বসার জন্য, খাবার জন্য একটু রিফ্রেশ হওয়ার জন্য ব্যবস্থা নেই কেন? আধুনিক সুযোগ সুবিধা কিছুই নেই। ওয়াশরুম বা টয়লেট যা আছে তা খুবই নিম্ন মানের বলে জানান তিনি। এখানে সরকারি উদ্যোগে পর্যটনের রেষ্টরুম ও রেষ্টুরেন্ট থাকা উচিত বলে জানান তিনি।
এ সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন ফরিদপুর থেকে আগত এক দম্পতি সোহেল ও শবনম। তারা বললেন, পশ্চিম পাড় থেকে আমরা দ্রুত এপাশে চলে এসেছি। ওপাশে এখন মোটরসাইকেল নিয়ে একদল বখাটে আড্ডা দিচ্ছে। দুর্গন্ধের সিগারেট বা গাঁজা ব্যবহার করছে ওরা। এটা এখানে আশা করিনা আমরা।
পটুয়াখালী থেকে আগত দু,জন দর্শনার্থী বলেন, পর্যটন স্পট এটি। টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। অথচ ভিতরে রয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। যেখানে বিনা টিকিটের রোগী প্রবেশ করেন। অনেকেই এটা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। ভিতরে ভিক্ষুকের জন্য বসা যায় না বলে জানান তারা।
এসময় বেশ আন্তরিকতা নিয়ে ছুটে এলেন এখানকার দীর্ঘদিনের কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর খান। তিনি জানালেন, চলমান পরিস্থিতিতে কিছু সমস্যা হচ্ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার চেষ্টা চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে বরিশালের জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন দুইবার ঘুরে গেছেন এখানে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটও এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। চারপাশে দেয়াল নির্মাণ শেষ হয়েছে। প্রধান ফটকের কাজ শেষ হলেই কার পার্কিং ব্যবস্থার কাজ শুরু হবে। এগুলো শেষ হলে নিরাপত্তা বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
বরিশালের ভূমি ও পর্যটন দপ্তরের অধীনে মাধবপাশার এই দুর্গা সাগর দীঘিতে নিয়মিত মাছ ধরে নিয়ে যায় সরকারি কর্মকর্তারা। পদাধিকার বলে এটির সভাপতি জেলা প্রশাসক। প্রশাসনের উদ্যোগেই এখানে পিকনিক স্পট ও টিকিট কেটে মাছ ধরার ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রতিদিন এই দীঘি থেকে গড় আয় ৫০০০ টাকা। শুক্র ও শনিবার ১২-১৫ হাজার টাকাও হয় বলে জানা গেছে। এরপরেও দর্শনার্থীদের যত্নের কোনো ব্যবস্থা নেই এই পর্যটন স্পষ্টে।