চন্দ্রদ্বীপ নিউজ::বাংলাদেশে আমরা এমন একটা সময়ে ও বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কর্মসংস্থান প্রসঙ্গ বিবেচনা করছি, যেখানে আমাদের কিছু অনিবার্য প্রশ্ন করতেই হবে। কারণ, অনেকের কাছেই এখন কর্মসংস্থান প্রশ্ন ধাঁধা আকারে হাজির হয়েছে। বিগত দেড় দশকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিমের অর্থনীতিকেন্দ্রিক যেসব তথাকথিত মহাবয়ান—
যেমন প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন, রপ্তানি আয়, ‘ডিজিটাল’ বাংলাদেশের প্রযুক্তি-নিবিড় শিক্ষা ইত্যাদির মধ্যে আদতে কর্মসংস্থান প্রশ্নের কোনো সুরাহা হয়েছে কি না। যাবতীয় সামষ্টিক মহাবয়ানের মধ্যে থেকে আমরা কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী ও দক্ষ মানবসম্পদ সরবরাহযোগ্য করতে পেরেছি? সে ক্ষেত্রে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের তোড়জোড়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি এবং মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার গুঞ্জন কি কেবলই রাজনৈতিক ভোজবাজি ও বৈধতা উৎপাদনের উপাদান ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমাদের দরকার ওই মহাবয়ানগুলোর রাজনৈতিক অর্থনীতি তালাশ করা। এ জন্য এই রচনাকে পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাই করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের পুরো ক্ষেত্র অনেক বেশি সংকুচিত। কয়েকটা প্রচলিত খাতের মধ্যেই সব চাকরি সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে আবার সিংহভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক। যেমন তুলনামূলকভাবে কর্মসংস্থানের বড় কয়েকটি খাত হচ্ছে সরকারি চাকরি, কৃষি, সেবা, ভোগ্যদ্রব্য উৎপাদন, তৈরি পোশাক, অভিবাসন, মজুরিভিত্তিক শ্রম ইত্যাদি। কিন্তু এ ছাড়া বেশ কিছু সম্ভাবনাময় খাত রয়েছে, যেখানে শ্রমপ্রবাহ পর্যাপ্ত নয়। উল্লেখ্য, যে বৃহৎ জনশক্তি প্রচলিত খাতগুলোয় নিয়োজিত, ব্যতিক্রম বাদ দিলে সে খাতগুলোও দক্ষতানির্ভর নয়। ফলে দেশের বিপুল জনশক্তি অদক্ষ থেকে গেছে।
লক্ষণীয়, বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের খাতগুলোয় বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে বিস্তৃত করা এবং সেগুলোয় শ্রমপ্রবাহ ত্বরান্বিত করা সম্ভব না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু পরস্পর আন্তসম্পর্কিত কারণ রয়েছে। মোটাদাগে দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগের অভাব, খাতে বিদ্যমান অপ্রাতিষ্ঠানিকতা, প্রতিকূল ব্যবসায় পরিমণ্ডল, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা বিকাশের অভাব, অদক্ষ শ্রমপ্রবাহ, সরকারি চাকরির প্রতি অস্বাভাবিক ঝোঁক ইত্যাদি। প্রাতিষ্ঠানিক গুণগত মান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপস্থিতি ইত্যাদি রাজনৈতিক পূর্বশর্ত ছাড়াও বৈদেশিক বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক কাঠামো, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের নির্ভরযোগ্যতা, অপ্রাতিষ্ঠানিকতা, প্রতিকূল ব্যবসায় পরিমণ্ডল অন্যতম অন্তরায়। পাশাপাশি অদক্ষ শ্রমপ্রবাহও বিনিয়োগকারীদের বহুলাংশে নিরুৎসাহিত করে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাস্তবিক প্রতিবন্ধকতার প্রায় সব শর্তই আমাদের বেলায় খাটে। তবে অর্থনীতির আওতার বাইরে গিয়ে কর্মসংস্থানের সমস্যা ও চাকরিপ্রার্থী তরুণ জনগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক দিক এবং আমাদের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার দর্শনের মৌলিক ও নীতিগত গলদের পটভূমি আরও তলিয়ে দেখা দরকার।