ভূতুড়ে কৃষি ঋণের ফাঁদে পটুয়াখালীর মৃতরা

পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: বাউফলে স্বাধীনতার আগে মারা যাওয়া পাঁচজনসহ মোট ছয়জন মৃত ব্যক্তিকে ঋণ দিয়েছে ব্যাংক। মৃত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ২০১৪-১৫ সালে ব্যাংক থেকে বিভিন্ন অঙ্কের ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে আবার কারও কারও নামে রয়েছে একাধিক ঋণ।

পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কেশবপুর শাখায় এমন ঘটনা ঘটেছে।

ঋণ গ্রহীতা ব্যক্তিদের সবার বাড়ি উপজেলার সূর্য্যমনি ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনেরা কৃষি ব্যাংকের কেশবপুর শাখায় যোগাযোগ করলে কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করছেন বলে জানা গেছে।

ব্যাংক ও ভুক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালের ১১ডিসেম্বর কৃষি ব্যাংকের কেশবপুর শাখার কার্যক্রম শুরু হয়।
ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাউফলের সূর্য্যমনি ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের কেতাব উদ্দিন হাওলাদারের ৩ ছেলে জবেদ আলী, হজরত আলী ও রহম আলী ২০১৪ সালে ওই শাখা থেকে কৃষি ঋণ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে জবেদ আলীর নামে ২৫ ও ৩০ হাজার টাকার দুটি, হজরত আলীর নামে ৪৫ হাজার ও রহম আলীর নামে ৫০ হাজার টাকার ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জবেদ আলী ১৯৬০, হজরত আলী ১৯৬৫ ও রহম আলী ১৯৬৬ সালে মারা যান।

জবেদ আলীর ছেলের ঘরের নাতনি মোমেলা বেগম বলেন, তিনি তার দাদাকে দেখেননি। ২০১৪ সালে দাদার নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে তাও তারা জানেন না।

হজরত আলী হাওলাদারের ছেলের ঘরের নাতি মো. ফকরুল ইসলাম (৫৭) বলেন, আমার ৩ দাদার নামে লোন। আমি জন্মের পরে তাদের দেখি নাই। ২০২০ সালে ব্যাংক থেকে নোটিশ আসার পরে আমরা লোন সম্পর্কে অবহিত হই। এরপর বারবার কৃষি ব্যাংকে যোগাযোগ করে প্রতিকার চাইলেও ম্যানেজাররা কোনো প্রতিকার করে নাই।

কালিকাপুর গ্রামের আহম্মদ আলী হাওলাদারের ছেলে মো. জয়নাল হাওলাদার মারা যান ১৯৬৯ সালে। তার নামে ২০১৪ সালে ৪০ হাজার টাকার কৃষি ঋণ তোলা হয়েছে।

জয়নালের ছেলে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য মো. আবুল বাশার (৬৪) বলেন, তার বাবার মৃত্যুর সময় ব্যাংকের শাখাই ছিল না। ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়ে জানতে পারেন, বাবার নামে ২০১৪ সালে ঋণ তোলা হয়েছে।

অপর ঋণ গ্রহীতা জয়নাল আবেদীন হাওলাদারের ছেলে আসাল উদ্দিন হাওলাদার (৮০) বলেন, আমার বাবা মারা গেছেন ৭০/৮০ বছর আগে আমার বয়সও ৮০ বছর। সেই বাবার নামে একটা লোন, এই লোন তো আমরা নিই নাই, লোন সম্পর্কে কিছু জানি না। একি আজব ঘটনা।

আরো পড়ুন : বাউফলে চুরির অভিযোগে ২ যুবক গ্রেফতার

কালিকাপুর গ্রামের মো. বাবুল মৃধা (৪৪) ঢাকায় থাকেন। তিনি কোনো দিন কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নেননি। তার নামে কেশবপুর শাখা থেকে ২০১৪ সালে ১৭ হাজার ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। তার ছোট ভাই ফারুক হোসেন মৃধার (৪২) নামে ৭৫ ও ১৭ হাজার টাকার দুটি ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে।

আবদুল করিম মৃধা নামের এক ব্যক্তির নামে ৩৫ হাজার টাকার ঋণ উত্তোলন দেখানো হয়েছে। গ্রাম কালিকাপুর উল্লেখ করা হলেও তার বাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে রুস্তম আলী মৃধা। অথচ এ নামের কাউকে কালিকাপুর গ্রামে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অপরদিকে একই এলাকার মৃত আব্দুল ছত্তার মৃধার ছেলে বাবুল মৃধার নামে রয়েছে ১৭ হাজার টাকার ঋণ। বাবুল মৃধার স্ত্রী হামিদা বেগম জানান, তার স্বামী কৃষি ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেননি। তবে ঋণের জন্য আবেদন করেছিলেন। তারপর একদিন ঋণ পাশ হয়েছে জেনে ব্যাংকে গেলে ব্যাংক থেকে জানানো হয় আজকে টাকা পাবেন না। এরপর আর কখনো কৃষি ব্যাংকে যাননি এবং কোনো টাকা নেননি।

২০১৪ সালে কেশবপুর শাখার মাঠ কর্মকর্তা ছিলেন মো. শফিউর রহমান। পাঁচ বছর আগে তিনি অবসরে চলে গেছেন। তাঁর দাবি, তিনি কোনো মৃত ব্যক্তি কিংবা নামে-বেনামে কারও ঠিকানা ব্যবহার করে ঋণ দেওয়ার সুপারিশ করেননি।

এ প্রসঙ্গে উপজেলার সূর্য্যমনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন বাচ্চু বলেন, যাদের নামে লোন নেওয়া হয়েছে বলে জেনেছি তারা ৫০/৬০/৭০ বছর আগে মারা গেছেন। একটা চক্র এই কাজ করছে জানিয়ে লোন নেওয়ার ঘটনাকে তিনি মিথ্যা, বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক বলে মনে করেন।

কৃষি ব্যাংকের কেশবপুর শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক হুসাইন মো. তাইফ আলম জানান, গত সপ্তাহে (মঙ্গলবার) ৪/৫ জন লোক এসে তাকে বিষয়টি জানান। তারা ২০২০ সালে ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়েছেন। এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ঋণগুলো ২০১৪-১৫ সালে অনুমোদন করা হয়েছে। এরপর তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা বিষয়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখছেন এবং বিষয়টি এখন তদন্তাধীন রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি ব্যাংকের বিভাগীয় মহা ব্যবস্থাপক গোলাম মাহবুব বলেন, মৃত ব্যক্তির নামে লোন মঞ্জুর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি, তদন্ত রিপোর্ট পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।




রিমালে ঈদ আনন্দ ভেসে গেছে উপকূলবাসীর

বরিশাল  অফিস :: ‘ঘর-দুয়ার উডামু, না কুরমানি দিমু? ঘরডা পইররা গ্যালহে, ধারদেনা আইন্না কোনো রহম খানচাইরে খুডি দিয়া খারা হরছি, ব্যারাহ্যা দেতে পারি নাই। ঘরে চাউল দুগ্গা আছে, ক্ষ্যাতে আবার আডি লাগাইছি চারা কেবল ওটছে। ক্ষ্যাতে এহন কিছু নাই যে বেইচ্যা বাজার করমু। কৃষিবাদা যা দেলহাম সব বইন্যায় ঢইল্লা লইয়া গ্যাছে। আয় ইনকাম বন্ধ, কুরমানি দিমু ক্যামনে? ঈদের দিন একটা ব্রলার মুরহা আইন্না বউ-গুড়াগাড়া লইয়া খামু’। প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত বরগুনা উপকূলবাসীর ঈদের খোঁজখবর নেওয়ার সময় কথাগুলো কালবেলাকে বলেন সদর উপজেলার ৪নং কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের ডৌয়াতলা এলাকার কৃষক আক্কাস মৃধা।

গত ২৬ মে বরগুনাসহ দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল। বরগুনা উপকূলে ২৬ মে থেকে ২৭ মে পর্যন্ত প্রায় ১৫ ঘণ্টা যাবত বৃষ্টি, ঝোড়ো বাতাস সঙ্গে সাগর ও নদীতে পানি বৃদ্ধি করাসহ উত্তাল ঢেউ উপকূলে আছড়ে দিয়ে শক্তির দাপট দেখিয়ে গেছে রিমাল। ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল হারিয়ে একপ্রকার অসহায় জীবনযাপন করছেন এ জেলার অধিকাংশ মানুষ।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে জেলার আনুমানিক ৩ হাজার ৩৭৪টি ঘর সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হওয়াসহ ১৩ হাজার ৩৪টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বরগুনার ৬টি উপজেলার প্রায় তিন শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বেশি ক্ষতি হয়েছে। বরগুনা সদর উপজেলার আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের রামরা ও আয়লা গ্রামের দুই পয়েন্টের বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়াও জেলাজুড়ে বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ে সড়কে যানবাহন চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টিসহ বেশ কয়েকদিন জেলার বেশিরভাগ গ্রামেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।

জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে সরকারি সহায়তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্তরা পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। মাঠে মাঠে আবার বুনতে শুরু করেছে বিভিন্ন ফসলের বীজ। গামছায় চোখের জল মুছে শক্ত করে কোমর বেঁধে রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন প্রায় প্রতিবছর বন্যাকবলিত জেলা বরগুনার মানুষ। এরই মধ্যে বাঁধভাঙা খুশির জোয়ার নিয়ে এসেছে মুসলমানদের কোরবানির ঈদ।

দেশের অন্য জেলাগুলোতে যখন কোরবানির জন্য পশু ক্রয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ঈদের আমেজ ছড়াচ্ছে। তখন বরগুনা জেলার বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ছল ছল চোখে দেখে শুকনো মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। অনেক পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ক্ষেতের ফসল রিমাল নষ্ট করে দিয়ে যেন তাদের ঈদের আনন্দটুকুও ধমকা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আগের বছরের মতো আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে ছেলে-মেয়ে, ভাইবোন সবাই একসঙ্গে বসে গরু কিংবা ছাগলের মাংস খাওয়া হবে না তাদের, ব্রয়লার মুরগিতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।

জেলার বামনা উপজেলার চলা ভাঙ্গা এলাকার জামাল কালবেলাকে বলেন, ‘কুরবানীর জন্য কোথায় ভাগ হবো? গরু কবে কিনবো? ঘরে গেলেই ছেলে মেয়েরা জানতে চায়। ঘূর্ণিঝড়ে এমন অবস্থা হইছে এবার কোরবানি দেওয়ার মতো কোনো কায়দা নাই’।

পাথরঘাটার পদ্মা এলাকার জেলে নাসির বলেন, ‘মহাজনের ট্রলারে থাহি। টাহাটোহা লাগলে মাঝে মধ্যে আনতাম। এহন মহাজনেই বিপদে আছে। বইন্নার সময় ঢ্যাফায় পিডাইয়া ট্রলারডারে অ্যাক্কালে নাজুক বানাইয়া হালাইছে। হুনছি এনজিওর লোন উডাইছে, হ্যারপর ধারদেনা আইন্না ট্রলারডার কাম হরায়, কুরবানীও দেবে না আবার। হ্যার দারেও বা কি কমু। ওই আল্লায় যা হরে’।

সদর উপজেলার মোল্লারহোড়া এলাকার প্রবাসীর স্ত্রী পারুল বেগম  বলেন, ‘বইন্নায় ঘরডা হালাইয়া দেলহে। এফির যে টাহা পাডাইছে হ্যাইদ্দা গাছ-খুডি কিন্না ঘরের কাাম ধরছি। কোরবানী দেওয়ার মতো টাহা হাতে নাই। কী কমু শরমের কথা নতুন বেয়াইবাড়ি দাওয়াত দিতে পারি নাই’।

সদরের ফুলঝুরি বাজারের লঞ্চঘাট এলাকার ফিরোজা বেগমের ঘূর্ণিঝড় রিমালে তাণ্ডবে ভাঙা ঘর এখনো সারতে পারেননি। ভাঙা ঘরেই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন এখনও। ঘরের পাশে গালে হাত দিয়ে চিন্তিত মনে  বলেন, টাকার অভাবে ভাঙা ঘর এখনো সারাতে পারিনি, কোরবানি দেওবার কথা তো চিন্তাই করতে পারি না। কোরবানি দিনে ছেলে মেয়েদের সামনে যে একটা ব্রয়লার মুরগি কিনে সামনে দেব তার কোনো ব্যবস্থা নাই।

এ ছাড়াও জেলার অন্য উপজেলাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বেশিরভাগ মানুষ পুনর্বাসিত হতে গিয়ে ঈদের আনন্দ মলিন হয়ে গেছে তাদের।




১৬ বছরের উন্নয়নে বদলে গেছে দ্বীপজেলা ভোলা

বরিশাল অফিস :: বঙ্গোপসাগর মোহনায় মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীবেষ্টিত দেশের একমাত্র সর্ববৃহৎ দ্বীপজেলা ভোলা গত ১৬ বছরের উন্নয়নে বদলে গেছে। এক সময়ে খ্যাতি ছিল ধান সুপারি আর ইলিশের ভাণ্ডার হিসেবে। কিন্তু ধান সুপারি আর ইলিশ এই তিনের মধ্যে এখন আর এই জেলার সীমাবদ্ধতা নেই। প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদে ভরপুর দেশের সর্বদক্ষিণের এই জেলা এখন বাংলাদেশের একটি অপার সম্ভাবনাময় জেলায় পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চার মেয়াদে নতুন নতুন প্রকল্প আর উন্নয়নের জোয়ারে একদিকে যেমন এখানকার দৃশ্যপট বদলে গেছে, অন্যদিকে সৃষ্টি হচ্ছে বেকার যুবকদের কর্মস্থান।

সেই উন্নয়নের ছোঁয়া শুধু শহরই নয়, পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত গ্রাম গঞ্জেও। এমনকি এক সময়ের কাল্পনিক স্বপ্নও বাস্তবে রূপ নিয়েছে। জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দুর্গম চরাঞ্চলেও পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ সুবিধা। সাবমেরিন ক্যাবল এর মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে এই বিদ্যুৎ। এখন দিনের আলো শেষে রাতের আঁধারে বিদ্যুতের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠে মানুষের ঘরবাড়ি। এতে করে ঘুচে গেছে শহর-গ্রামের পার্থক্য। যা ছিল এখানকার মানুষের জন্য এক অকল্পনীয় অধ্যায়।

এছাড়া জেলার সর্বদক্ষিণের সাগর মোহনার দ্বীপ চর কুকরি-মুকরি ও মনপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে সরকারী নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইতিমধ্যে সেখানে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। যা ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের কাছে নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি নদী গর্ভে ঘরবাড়ি বিলীন হওয়ার আতঙ্ক আর নেই। মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেয়েছে ভোলার ভাঙ্গন কবলিত এলাকাবাসী। এছাড়া দ্বীপের ২০ লক্ষাধিক মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ভোলা-বরিশাল সেতু এখন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই সেতু নির্মাণ হলে শুধু ভোলাবাসীই নয় দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের অর্থনীতিতে বিশাল এক বিপ্লব ঘটবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ভোলায় একের পর এক জ্বালানি গ্যাস কূপের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। ভোলার ইলিশা-১ নামে নতুন একটি কূপ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে বাপেক্স। এ নিয়ে জেলার মোট ৯টি কূপে গ্যাসের সন্ধান পেল বাপেক্স। ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধি সরেজমিন ভোলার সর্বত্র পরিদর্শন করে এই চিত্র দেখেছেন।

১৯৮৪ সালে মহাকুমা থেকে ভোলা জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে রয়েছে ৭টি উপজেলা, ৫টি পৌরসভা, ৭০টি ইউনিয়ন, ১০টি থানা। ৩ হাজার ৪০৩.৪৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে নদী ভাঙ্গন। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলেও সুপরিকল্পিত কার্যকরী কোন পদক্ষেপ বা কাজ বাস্তবায়ন হয়নি। যা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চার মেয়াদে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অনেক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক সহযোগিতায় তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ভোলা-১ আসনের সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের প্রচেষ্টায় সরকারের একের পর এক উন্নয়নে ভোলা বাংলাদেশের মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ জেলায় রূপান্তরিত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে করে পাল্টে যাচ্ছে চিরচেনা দ্বীপ জেলা ভোলার সেই পুরনো চিত্র। দেড় যুগ আগের পিছিয়ে থাকা ভোলা শহর এখন পরিণত হয়েছে আধুনিক পরিকল্পিত নগরীতে। ভোলা জেলা শহর ছাড়াও উন্নয়নের ছোঁয়া গেছে সব উপজেলাতেও। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে আমূল পরিবর্তনের ফলে সুফল পাচ্ছে এলাকার জনগণ। দ্বীপজেলা ভোলায় ইতোপূর্বে নদী ভাঙ্গন রোধে কার্যকরী তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তাই নদী ভাঙ্গনে বহু এলাকা বিলীন হয়ে যায়। ভোলা সদরের ইলিশা জংশন এলাকায় যখন রাক্ষুসে মেঘনার ভয়াবহ ভাঙ্গনে যখন হাজার হাজার বসত ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা, বাজার বিলীন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল ঠিক তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকা সিসি ব্লক স্থাপনের মাধ্যমে ইলিশা বাজারসহ বহু সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা রক্ষা পায়। ভোলায় অসংখ্য রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, জেলা শহরে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, পৌরভবনসহ সরকারী অসংখ্য বহুতল ভবন, ভোলা খেয়াঘাটে আধুনিক টার্মিনাল, নদী বন্দর স্থাপনসহ ব্যাপক উন্নয়নে গত ১৬ বছরে পাল্টে গেছে ভোলার চিত্র।

ভোলার চরফ্যাসনের বাসিন্দা রাহাত হোসেন (৬২) জানান, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চরফ্যাসন আধুনিক ও পর্যটন উপজেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। চর কুকরি মুকরিতে আধুনিক রেস্ট হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। চর কুকরিতে বঙ্গবন্ধু ইকোপার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। তাছাড়াও চরফ্যাসন মনপুরায় প্রায় হাজার কিলোমিটার পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। চরফ্যাসন ও মনপুরাবাসীকে রক্ষা করার জন্য হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ব্লকবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। চরফ্যাসনে শতভাগ ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। এমনকি চরফ্যাসনের বিচ্ছিন্ন দ্বীপচর ইউনিয়ন মুজিবনগর ও কুকরি মুকরিতে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চরফ্যাসনে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে।

এদিকে লালমোহন ও তজুমদ্দিন উপজেলায় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হয়েছে। লালমোহন ও তজুমদ্দিনে মেঘনার ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষায় প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সিসি ব্লক স্থাপন করা হয়েছে। অসংখ্য রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স, থানা কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। লালমোহন ও তজুমদ্দিনে ঘুরলে বর্তমান সরকারের অসংখ্য জনবান্ধবমুখী উন্নয়ন পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। গ্যাসভিত্তিক ভোলায় বিভিন্ন শিল্পকলকারখানা স্থাপন শুরু হয়।দ্বীপবাসীকে ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য ভোলা জেলার ৭ উপজেলায় ৫২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯৭টি সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। ভোলার প্রাকৃতিক সম্পদককে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা।

পর্যটকদের হাতছানি দিচ্ছে চরফ্যাশন: ভোলার চরফ্যাসনের কুকরি মুকরির ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল যেন এক মিনি সুন্দরবনে পরিণত হয়েছে। সেখানে এক সঙ্গে সাগরের ঢেউ, সূর্যদয়, বিশাল সমুদ্রের জলরাশি আর সমুদ্য সৈকত, লাল কাঁকড়া, বনের হরিণ, নানা পশু পাখির সমারোহ ভ্রমণপিপাসুদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জেলাটির বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে ছোট-বড় চর। এরমধ্যে আয়তনে বড় এবং একইসঙ্গে ঘুরে দেখার মতো উপজেলাটির নাম চরফ্যাশন। বলা হয়ে থাকে, সবুজ শ্যামলিমায় ভোলা জেলাকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখতে হলে আসতে হবে চরফ্যাশনে। অর্থাৎ চরফ্যাশনে অবস্থিত সু-উচ্চ ১৮ তলা জ্যাকব টাওয়ারে উঠলেই দেখা মিলবে পুরো জেলা। ১০০ টাকার টিকেট কেটে লিফটের সাহায্যে উপরে উঠে সর্বোচ্চ স্থান থেকে চারদিকে তাকানোর সুন্দর সুযোগ রয়েছে। ওখান থেকে যেদিকেই চোখ পড়ে দেখা মিলবে সবুজের সমারোহ। যেন, প্রকৃতির অপূর্ব লীলাভূমি হাতছানি দিয়ে ডাকে।

টাওয়ারের একেবারে পাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ এবং শহীদ শেখ রাসেল শিশু পার্ক। প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষের এখানে ভীড় করতে দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চরফ্যাশনে পর্যটকদের কথা চিন্তা করে তৈরি হয়েছে হোটেল ও রিসোর্ট। বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

ঢাকা থেকে চরফ্যাশনে আসা একজন ভ্রমন পিপাষু মানুষের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা হয়। লোকটির নাম নাজমুল করিম পেশায় ব্যাংকার। তিনি জানান, একটি চওড়া এবং সোজা সড়ককে ঘীরে ভোলা জেলা। ভোলা সদর থেকে চরফ্যাশন যেতে ভিন্ন পথের প্রয়োজন পড়ে না। তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা জেলার নাম ভোলা।

এদিকে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বেশকিছু চর। আর এসব চর ঘিরেই পর্যটনশিল্প অপার সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছে ভোলাবাসী। এই যেমন চর কুকরি-মুকরি প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে চমকপ্রদ ও আকর্ষণীয়। ইতোমধ্যে এখানকার জীববৈচিত্র্য ও দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের নজর কাড়তে শুরু করেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, চর কুকরি-মুকরিতে রোপণ করা হয়েছে নানা ধরনের গাছ।

এরমধ্যে কেওরা গাছ বৃহত্তর এলাকা জুড়ে দাপটের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর কৃত্রিম এই বনে ছাড়া হয়েছে বন্য মহিষ, হরিণ ও বানর। আছে গরুও। চর স্বল্প পরিমাণে বসতিও আছে। যাদের প্রায় সবাই মৎস্যজীবী।

এলাকাটির বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এটি এক পাশে মেঘনা অন্যপাশে বঙ্গোপসাগরের জলরাশি। লবণাক্ত এবং মিঠাপানির জলের মিশ্রণ চর কুকরি-মুকরিতে জোয়ার ভাটার খেলা করে। ওখানের ওয়াচ টাওয়ারে তাকালে পুরো বনটি দেখতে সৌন্দর্য অবলোকন করা হয় সহজেই। চরফ্যাশন সদর থেকে থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্ব এই চর। স্বল্প খরচে একা বা যৌথভাবে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে স্পিডবোর্ডে গেলে খরচ বাড়লেও দ্রুত পৌঁছে যাওয়া যায়। মাঝেমধ্যে সমুদ্র গর্জন তুললেও বেশিরভাগ সময় জুড়ে থাকে খুব নিবীর এবং নিরাপদ।

চরফ্যাশনে ব্যক্তিগতভাবে গড়ে ওঠা আরেকটি দর্শনীয় এবং বিনোদন কেন্দ্রের নাম খামারবাড়ি রিসোর্ট। আগে থেকে যোগাযোগ করে সেখানে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বৃহদায়তন এই রিসোর্টে আছে খাওয়া, থাকা এবং ঘুরে বেড়ানোর সু-ব্যবস্থা।

একই উপজেলায় আকর্ষণীয় স্থান হলো ঢাল চরের তারুয়া সমুদ্রসৈকত। এখানে পর্যটকদের চোখে ধরা দেয় লাল কাঁকড়াসহ নানা প্রজাতির অতিথি পাখি। বেতুয়া প্রশান্তি পার্কও দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। মেঘনা নদীর পাড়ে গড়া ওঠা এ পার্কে পর্যটকদের আনাগোনা সব সময় লেগেই থাকে।

চরফ্যাশনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সালেক মূহিদ জানান, মানুষ একসময় উন্নয়নে পিছিয়ে থাকলেও এখন উন্নয়নের হাওয়া লেগেছে কমবেশি সবখানে। মানুষের জীবনযাত্রায় এসেছে পরিবর্তন। ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে গতিশীল। শিক্ষার আলো, বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। রাস্তাঘাটের চেহারায়ও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। চরফ্যাশনের মতো একটি সম্ভাবনাময় উপজেলা পর্যটন খাতকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা।

চরফ্যাশন এলাকার অটোরিকশা চালক রিপন জানান, এখানে রাত বিরাতে নির্ভরে মানুষ চলাচল করে। অতীতে কিছু জটিলতা ছিলো এখান একেবারেই শান্ত ও শৃঙ্খল।




স্ট্রেস দূর করার ৭ উপায়




ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য যেসব ফল উপকারী




ফোনে চার্জ ধীরে হচ্ছে? এই টিপস মানলে বাড়বে গতি




গরমে ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলবেন কেন?




স্মার্টফোন হারিয়ে গেলেও ছবি-তথ্য সুরক্ষিত রাখবে যেভাবে




সবচেয়ে উপকারী ৫ শাক




এবার সুপার কম্পিউটার তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইলন মাক্স