বরিশালে শহীদ আসাদ দিবস পালিত

বরিশাল অফিস :: বরিশালে ৬৯ এর গণ অভুত্থানের নায়ক শহীদ আসাদের ৫৫তম দিবসটি যথাযোগ্য মর্যদায় উদযাপন উপলক্ষে আসাদের অস্থায়ী প্রতিকৃর্তিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও আলোচনা সভা,আবৃত্তি ও গণসংগীত পরিবেশন করেছে শহীদ আসাদ পরিষদ বরিশাল জেলা শাখা।

শনিবার (২০) জানুয়ারী সকাল সাড়ে ১০টায় অশ্বিনী কুমার টাউন হলে সম্মুখে কর্মসূচি পালিত হয়।

আসাদ পরিষদের সভাপতি ডাঃ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে ও শামিল শাহরুখ তমালের সঞ্চলনায় এসময় শহীদ আসাদকে স্মরন করে বক্তব্য রাখেন সাধারন সম্পাদক জ্যোতির্ন্ময় চক্রবর্তী রতন, অধ্যাপক আমিনুর রহমান খোকন,অধ্যাপক মহসিন-উল-ইসলাম হাবুল,একে আজাদ,মনিষা চক্রবর্তী,আরিফুর রহমান মিরাজ,সুজয় শুভ,বিজন সিকদার, মিন্টু দে, কিশোর চন্দ্র বালা সহ সাবেক ও বর্তমান ছাত্রনেতৃবৃন্দ ।

এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ওয়াকার্সপার্টি নেতা মোজাম্মেল হক ফিরোজ,অধ্যক্ষ আঃ মোতালেব সহ বিভিন্ন সংগঠন নেতৃবৃন্দ। আসাদ দিবস স্মরনসভা অনুষ্ঠানে আবৃত্তি ও গণসংগীত পরিবেশন করে শালিণ্য স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক
সংগঠন,বরিশাল।

এর পূর্বে শহীদ আসাদের প্রতিকৃতিতে আসাদ পরিষদ,বাসদ, গণ সংহতি আন্দোলন,ছাত্র ইউনিয়ন ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পৃথকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।




জেলা শিল্পকলা একাডেমির সম্মাননা পেলেন মুজাহিদ প্রিন্স

মো: আল-আমিন (পটুয়াখালী): নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য নাট্যকলা বিভাগে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সম্মাননা পদক পেলেন নাট্যজন মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স।

শিল্প-সংস্কৃতি ঋদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ গড়তে নিরন্তর কাজ করছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এরই ধারাবাহিকতায় পটুয়াখালী জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রতিবছর নানা বিষয়ে বিশেষ অবদানের জন্য গুনীজনদের ‘জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা’প্রদান করে আসছে। এ বছরেও (২০১৮-২০২২) সর্বমোট ২৫ জন গুনীজনকে সম্মাননা প্রদান করেছে জেলা শিল্পকলা একাডেমি।

বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে জেলা কালচারাল অফিসার কাজী মোঃ কামরুজ্জামান এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মোঃ নূর কুতুবুল আলম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি স্বপন ব্যানার্জী।

নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য নাট্যকলা বিভাগে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সম্মাননা পদক পেলেন নাট্যজন মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স। সম্মাননা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে নাট্যজন মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্সের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন জেলা প্রশাসক।

জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার কাজী মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, প্রতি বছরেই আমরা নানা বিষয়ে বিশেষ অবদানের জন্য গুনীজনদের সম্মাননা প্রদান করে থাকি। এবছরেও তারই ধারাবাহিকতায় আমরা গত পাঁচ বছরে (২০১৮-২০২২) ২৫ জন গুনীজনকে সম্মাননা প্রদান করেছি। নাট্যকলা বিভাগে নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য নাট্যজন মুজাহিদ প্রিন্সকে সম্মাননা পদক প্রদান করতে পেরে আমরা জেলা শিল্পকলা একাডেমি গর্বিত। তার অনন্য প্রতিভায় ও সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ হবে আমাদের পটুয়াখালীর নাট্যাঙ্গন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

সাংস্কৃতিক সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা মানস কান্তি দত্ত বলেন, প্রিন্স আমার সন্তানের মতো। প্রিন্সকে যখন আমি হাত ধরে ড্রামাটিক ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিলাম তখনি বুঝেছিলাম এই ছেলে একদিন পটুয়াখালীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের হাল ধরবে। ঠিক তাই হয়েছে৷ প্রিন্সের এই সফলতায় এই সম্মাননা প্রাপ্তিতে আমি গর্বিত এবং আনন্দিত। আমাদের পটুয়াখালীর থিয়েটারের সোনালী অতীত ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রিন্স ও তার দল ‘সুন্দরম’ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রিন্সের বিচক্ষণ দক্ষতায় প্রসারিত হোক পটুয়াখালীর নাট্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন।

নাট্যজন প্রফেসর এম. নুরুল ইসলাম বলেন, প্রিন্সের দূরদর্শী পরিকল্পনা, দায়িত্বশীলতা ও সৃজনশীল মেধা শক্তির জন্যে আজ পটুয়াখালীর সাংস্কৃতিক অঙ্গন অনেকটাই মসৃন ও প্রশংসনীয়। সাংস্কৃতিক কর্মীদের অধিকার আদায়ে প্রিন্সের কন্ঠস্বর সর্বদাই বলিষ্ঠ ভুমিকায় ছিলো৷

নাট্যজন মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স বলেন, এই সম্মাননা পদক আমাকে আরও ভালো কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেছে। মফস্বলে নাট্যচর্চাকে বেগবান করতে আমার দায়িত্ববোধ আরও বাড়িয়ে দিলো এই পদক। পটুয়াখালীতে থিয়েটারের সোনালী অতীত ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আমি ও আমার দল ‘সুন্দরম’ কাজ করে যাচ্ছি। আমাকে নাটকে বিশেষ অবদানের জন্যে সম্মাননা পদক প্রদান করায় আমি জেলা শিল্পকলা একাডেমিকে ধন্যবাদ জানাই।




ইসলামে দেশপ্রেম

দেশপ্রেম একটি মহৎ গুণ। সব নবি-রাসূল ও মহামানবের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় দেশপ্রেম ছিল। ইসলামের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখতে পাই, পূর্বসূরি মনীষীরা স্বদেশ ও স্বজাতিকে নিজের সন্তান ও পরিজনের মতো ভালোবাসতেন। স্বদেশ ও স্বজাতির অধিকার আদায়ে যুগে যুগে ইসলামি চিন্তাবিদরা, ধর্মভীরু ব্যক্তিবর্গ তাদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। তাদের মধ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইমাম হোসাইন (রা.) সপরিবারে শহাদতবরণ, ওমর বিন আবদুল আজিজ (রা.), মুহম্মদ বিন কাসিম, সাইয়্যেদ আহমদ শহিদ, ইসমাঈল শহিদ, মীর নিসার আলি তিতুমির, টিপু সুলতানসহ অসংখ্য মুসলিম নেতা দেশের স্বাধীনতা, মানুষের ধর্মীয় ও জাগতিক অধিকারের জন্য জীবন দান করে গোটা উম্মতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আরবি ভাষায় একটি বাণী স্বতঃসিদ্ধ আছে ‘হুব্বুল ওয়াতান মিনাল ইমান’। ‘দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’। দেশের প্রতি ভালোবাসা মহব্বত ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। জন্মভূমি মক্কা মোকাররমার প্রতি মহানবি (সা.)-এর অপরিসীম ভালোবাসার কথা কে না জানে। মহানবির শিক্ষাই হচ্ছে দেশের প্রতি দেশের মানুষের প্রতি প্রাণী জগতের প্রতি ভালোবাসা। মহানবি (সা.)কে প্রতিপক্ষের প্রভাবশালী লোকেরা হিংস্রতার চরম নিষ্ঠুরতায় মক্কা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করল। তিনি যখন পবিত্র মদিনার উদ্দেশে যাচ্ছিলেন তখন পেছন ফিরে প্রিয় মাতৃভূমির দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলেছিলেন, ‘ভূখণ্ড হিসাবে তুমি কতই না উত্তম, আমার কাছে তুমি কতই না প্রিয়। যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিত তবে কিছুতেই আমি অন্যত্র বসবাস করতাম না’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৯২৬)। এছাড়া আরও অনেক হাদিসে দেশপ্রেমের কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ আমাদের অহংকার। এ দেশ আমাদের গৌরবের মিনার। সুতরাং দেশের প্রতি, প্রতিটি নাগরিকের ভালোবাসা থাকা আবশ্যকীয়। এ ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ আমাদের দেশপ্রেমের প্রতি উৎসাহ দেয়। ইসলামে রয়েছে দেশপ্রেমের অত্যধিক গুরুত্ব। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের ন্যায়পরায়ণ শাসকের আদেশ মেনে চল’ (সূরা নিসা : ৫৯)। আরও ইরশাদ হয়েছে-‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। আর তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাবান সে, যে আল্লাহকে সর্বাধিক ভয় করে (সূরা হুজুরাত, আয়াত : ১২)। হাদিসে এসেছে; হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি খেদমতের নিয়তে রাসূলের সঙ্গে খায়বার অভিযানে গেলাম। অতঃপর যখন অভিযান শেষে নবি করিম (সা.) ফিরে এলেন, উহুদ পাহাড় তার দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি বললেন, এ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও একে ভালোবাসি (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৮৮৯)। এছাড়া হুজুর (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘হে লোক সকল! জেনে রেখ! তোমাদের প্রতিপালক একজন। জেনে রেখ, অনারবের ওপর আরবের, আরবের ওপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার ওপর কালোর, কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে একজন আরেকজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারবে’ (মুসনাদ আহমদ, ৫/৪১১; বায়হাকির সূত্রে দুররে মানসুর ৬/১২২)। মহানবি (সা.) আরও বলেন, দেশ রক্ষার জন্য সীমান্ত পাহারায় আল্লাহর রাস্তায় বিনিদ্র রজনি যাপন করা দুনিয়া ও এর মধ্যকার সব কিছুর চেয়ে উত্তম (বোখারি)। অন্যত্র বলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় এক রাতের রিবাদ একমাস ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখা এবং এক মাসের রাতগুলো ইবাদত করার চেয়ে উত্তম (মুসলিম শরিফ)। মহানবি আরও বলেন, জাহান্নামের আগুন দুটি চোখকে কখনোই স্পর্শ করবে না, যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে এবং যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় সীমানা পাহারায় বিনিদ্র রাত কাটায় (তিরমিজি)।

ড. মো. শহিদুল্লাহ বলেছেন, আমাদের মা তিনটি, একটি যিনি গর্ভধারণ করেন দ্বিতীয় আমরা যে ভাষায় কথা বলি সেটি আরেকটি হচ্ছে আমাদের মাতৃভূমি মা। দেশের সব নাগরিক রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সর্বস্তরের জনগণের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে দেশের প্রতি ভালোবাসা দেশকে সুন্দর রাখা বিজয় দিবসের এটিই হোক আমাদের অঙ্গীকার। মহান আল্লাহ সব দেশপ্রেমিক শহিদদের জান্নাতবাসী করুন এবং সুখ ও সমৃদ্ধিতে এ দেশ এগিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা। সব সময় আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসব।

মোহাম্মাদ মোস্তাকিম হোসাইন 




আজ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কাজী মতিয়ার রহমানের ৫২ তম শাহাদাত বার্ষিকী

বরিশাল অফিস: কলেজ পড়–য়া ছাত্র। তাগড়া যুবক। এই বয়সে বিশেষ কিছু বৈশিষ্টের মধ্যে অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে অকুতোভয় নামক শব্দটি। যে বৈশিষ্টটি অসাধ্যকে সাধন ও অজয় কে জয় করার দীপ্ত স্পৃহা জাগিয়ে তোলে। সেই স্পৃহার টানেই দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। বুকে দেশপ্রেম ধারন করে বীর দর্পে মোকাবেলা করেছেন পাক হানাদার বাহিনীর। কিন্তু দূর্ভাগ্য বিজয়ের স্বাদ অনুভব করতে দেয়নি সৃষ্টিকর্তা। যুদ্ধ তথা দেশ বিজয়ের মাত্র ২০ দিন পূর্বে শত্রুদের বুলেটে নিভে যায় দেশ মাতৃকার বীর সেনানী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বানারীপাড়ার কাজী মতিয়ার রহমানের জীবন প্রদীপ।

১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর রাতে পিরোজপুর জেলার স্বরুপকাঠি উপজেলার ছারছিনায় আলবদরদের ঘাটিতে আক্রমন চালাতে গেলে শত্রুদের বুলেটে মৃত্যু ঘটে তার। আজ বানারীপাড়ার গর্ব ও অহংকারের প্রতীক জাতির বীর সন্তান শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কাজী মতিয়ার রহমানের ৫২ তম শাহাদাত বার্ষিকী। বরিশাল জেলা পরিষদের তৎকালীন সদস্য কাজী মোশারেফ হোসেন এর কনিষ্ট পুত্র কাজী মতিয়ার তখন শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের প্রতিষ্ঠিত বানারীপাড়ার চাখার ফজলুল হক কলেজের ঘাতক শ্রেণীর ছাত্র এবং ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দেশ স্বাধীনের ডাকে সাড়া দিয়ে নেমে পড়েন রনাঙ্গনে।

তার স্মৃতি চারন করে বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী বলেন, মতিয়ার ছিলো অকুতভয়ী অসীম সাহসী এক যোদ্ধা। যুদ্ধের শেষ ভাগে ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষন নিয়ে নৌকা যোগে স্বরুপকাঠি ফিরছিলেন। এসময় জানতে পারেন ছারছিনা পীরের বাড়িতে রাজাকারদের একটি ঘাটি রয়েছে। তিনি মুহুর্তেই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ওই ঘাটিতে আক্রমন করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবসত শত্রুদের গুলিতে মৃত্যু ঘটে তার। কিন্তু তার লাশ আর পাওয়া যায়নি।

তিনি ৯ নং সেক্টরের মেজর জলিলের অধীনে যুদ্ধরত ছিলেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কাজী মতিয়ার রহমানের ভাইয়ের ছেলে কাজী এনায়েত করিম ইনু বলেন শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে গ্রামের বাড়ি বানারীপাড়ার জামে কেরামতিয়া জামে মসজিদে বাদ আছর দোয়া মিলাদের আয়োজন করা হয়। ৩ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে মতিয়ার ছিলেন সবার ছোট। অন্য দুই ভাইও ইতিমধ্যে মৃত্যু বরন করেছেন। তবে ২ বোন জীবিত রয়েছেন। উল্লেখ্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ কাজী মতিয়ার রহমান শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক আজকের পরিবর্তন পত্রিকার প্রকাশক-সম্পাদক কাজী মিরাজের ছোট মামা




শেরে বাংলা-জীবনানন্দের বরিশাল

এস এল টি তুহিন, বরিশাল : বিভিন্ন ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকে বরিশালের বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ থাকলেও এ জনপদের ভৌগোলিক উৎপত্তি নিয়ে নানা মত প্রচলিত রয়েছে। তবে বরিশাল অঞ্চলের উৎপত্তি যে প্রাগৈতিহাসিক যুগে বঙ্গোপসাগরের বুকচিরে জেগে ওঠা, এ নিয়ে বেশিরভাগ ঐতিহাসিক একমত পোষণ করেছেন। বরিশাল অঞ্চলের প্রাচীন নাম বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ। তবে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামের আগে এটি ‘বাঙ্গালা’ নামেও পরিচিত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, বাঙ্গালানামটি পরিবর্তিত হয়ে বাকলা হয়েছে। চতুর্দশ শতকে রাজা দনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তখন চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী ছিল বাকলা।

মুঘল আমলে বাকলায় সুবে বাংলার একটি সমৃদ্ধিশালী সরকারের শাসন ছিল। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নিয়ে বাকেরগঞ্জ নামে নতুন জেলা সৃষ্টি করা হয়। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জ জেলার সদরদপ্তর বরিশাল শহরে স্থানান্তরিত করা হয়। বরিশাল নামটি অনেকটা হাল আমলের।

প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক কালের ভৌগোলিক বিবরণ: 
বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক বিবরণের পাশাপাশি চন্দ্রদ্বীপের ভৌগোলিক বিবরণ রয়েছে। মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে কৌরব-পা-বদের যুদ্ধের পর ভগবান বলরাম গঙ্গার মোহনায় স্খান করেছিলেন এবং রাজসূয়া যজ্ঞের জন্য সাগর তীরের ম্লেচ্ছদের পরাজিত করে তিনি প্রচুর সম্পদ আহরণ করেছিলেন। পৌরাণিক গ্রন্থ মহাভারতে বাঙালিদের বা বাংলাদেশের অধিবাসীদের ম্লেচ্ছ ও দস্যু বলে অভিহিত করা হয়। রামায়ণে গঙ্গা দেবীর পাতাল প্রবেশের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ সকল পৌরাণিক কাহিনী বাংলা ও বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন ভূ-তত্ত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত করে। প্রসঙ্গত মহাভারত রচিত হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। অর্থাৎ এর থেকে ধারণা করা হচ্ছে সে সময়ে এ অঞ্চলের অস্তিত্ব ছিল।

রাজা চন্দ্রবর্মণ চতুর্থ শতকে কোটালিপাড়ায় দুর্গ নির্মাণ করেন। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সীমান্ত থেকে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার দূরত্ব নয়-দশ কিলোমিটার। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোটালিপাড়া বাকেরগঞ্জ জেলার অধীনে ছিল। ষষ্ঠ শতকে কোটালিপাড়ায় প্রাপ্ত পাঁচটি তাম্রশাসন প্রমাণ করে মৌর্য ও গুপ্ত আমলে চন্দ্রদ্বীপ উন্নত জনপদ ছিল। ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে বরিশালের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ গৌরনদী, উজিরপুর, হিজলা ও মুলাদি থানার অধিকাংশ ভূ-গঠন প্রাগৈতিহাসিক যুগের। সিরাজ উদ্দীন আহ্মেদ তার বরিশাল বিভাগের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেন, বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ এক সময় পূর্ব সাগর বা লবণ সাগরে নিমজ্জিত ছিল।

কোনো এক অজানাকালে গঙ্গা নদীর পলি জমে সুগন্ধা নদীর বুকে সৃষ্টি হয় একটি ত্রিকোণাকার ব-দ্বীপ। ওই দ্বীপের নাম স্ত্রীকর দ্বীপ। প্রাচীন স্ত্রীকর দ্বীপ বর্তমান শিকারপুর, উজিরপুর, গৌরনদী নামে পরিচিত। মৌর্য আমলে সুগন্ধার মোহনায় বর্তমান গলাচিপা, কাঁঠালিয়া, আমতলী, এবং গুপ্ত আমলে বরগুনা, বামনা, মঠবাড়িয়া ও পাথরঘাটা নিয়ে আলাদা কয়েকটি দ্বীপের সৃষ্টি হয়। স্ত্রীকর, শঙ্খকোট, পিরোজপুর দ্বীপের সৃষ্টি হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগে। পরবর্তী সময়ে এসব দ্বীপের মিলিত নাম হয় বাঙ্গালা। পাল ও সেন আমলে এ দ্বীপগুলো বাঙ্গালা ও চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল।

চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা :
রাজা রামনাথ দনুজমর্দনদেব চন্দ্রদ্বীপে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু দনুজমর্দনদেব কখন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ধারণা করেন চতুর্দশ শতকে তিনি রাজত্ব করেছেন। তবে চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের সপ্তম রাজা পরমানন্দ বসু ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে জীবিত ছিলেন। এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তিনি ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে কোটালিপাড়ায় শ্রী চৈতন্যদেবের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময়কে ধরে এক হিসাবে ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন, রাজা রামনাথ দনুজমর্দনদেব ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। রাজা রামনাথ দনুজমর্দন বর্তমান বাউফল থানার কচুয়াতে রাজধানী নির্মাণ করেন। বাজধানীর নাম ছিল ‘বাঙ্গালা’। তিনি রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাঙ্গালায় বন্দর নির্মাণ করেন। ওই বন্দরে আরব ও পারস্যের বণিকরা বাণিজ্য করতে আসতেন। তিনি নিজস্ব মুদ্রা চালু করেছিলেন। যা প্রমাণ করে তিনি স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন। পরবর্তী সময়ে চন্দ্রদ্বীপে নিজস্ব সেনাবাহিনীও ছিল।

চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন কীর্তি:
বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে প্রাগৈতিহাসিককালের কোনো কীর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়নি। চতুর্থ শতক হতে এ অঞ্চলের প্রাচীন কীর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, দীঘি, দুর্গ, তাম্রলিপি ও মুদ্রা। তবে লবণাক্ত পরিবেশ, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি ও নদীভাঙনে এলাকার অনেক কীর্র্তি বিলীন হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। আবার বিভিন্ন সময়ে মগ-পর্তুগীজসহ বহু বহিরাগত এ অঞ্চল লুটপাটের জন্য দখল করে নিয়েছিল। দখলকারীরা অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে। এরপরেও এ অঞ্চলে অসংখ্য স্থাপনা বা পুরার্কীতি রয়ে গেছে।

তেরো শতকের প্রথম ভাগের সেন বংশীয় রাজা বিশ্বরূপ সেনের একটি তাম্রশাসন পাওয়া যায় কোটালিপাড়ায়। ওই তাম্রশাসনে গৌরনদী থানার রামসিদ্ধি, বাঙ্গালা, ঝালকাঠি থানার নৈকাঠি ও চন্দ্রদ্বীপ নামের উল্লেখ আছে। হিজলা-মুলাদি থানার ইদিলপুরে কেশব সেনের একটি তাম্রলিপি পাওয়া যায়। তেরো শতকের ওই তাম্রলিপিতে ব্রাহ্মহ্মণকে ভূমি দান, চন্ডভন্ড জাতি শাসন ও মন্দির নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত মূর্তিগুলোর মধ্যে বাকেরগঞ্জের মাধবপাশা জমিদার বাড়ির কাত্যায়নী মূর্তি, শিকারপুরের তারামূর্তি ভারতবর্ষে বিখ্যাত। গৌরনদীর লক্ষণকাঠির বিষ্ণুমূর্তি বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

সুলতানী, মুঘল ও অন্যান্য আমলের প্রাচীন কীর্তি: 
চন্দ্রদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে মুসলিম স্থাপত্য শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয় সুলতানী আমলে বিশেষ করে ১৪৫৯ থেকে ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতান রুকনউদ্দীন বরবক শাহর শাসন আমলে। এ পর্যন্ত বরবক শাহের ১৫টি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। তার নামাঙ্কিত একটি শিলালিপি পাওয়া যায় পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মসজিদবাড়িতে। মির্জাগঞ্জের মসজিদবাড়ির মসজিদ নির্মাণ হয় ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গুরিন্দা গ্রামে রয়েছে গুরিন্দা জামে মসজিদ। এ মসজিদটিও বরবক শাহের আমলে নির্মাণ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মুঘল আমলের একটি উন্নত জনপদ হিসাবে পরিচিত ছিল গৌরনদীর কসবা। ওই আমলে কসবা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক মসজিদ নির্মাণ হয়। কসবা কাজীবাড়ির সামনে একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ রয়েছে। কসবা হাটের দক্ষিণ পাশে একটি, কাহারবাড়ির কাছে একটি এবং খলিফাবাড়ির কাছে একটি মসজিদের ধ্বংসস্তূপ রয়েছে। কমলাপুর গ্রামে তিন গম্বুজ ও তিন দরজা বিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে।

গুরিন্দা জামে মসজিদ:
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গলাচিপা উলানিয়া সড়কের পূর্ব পাশে গুরিন্দা খাল। ওই খালের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গুরিন্দা জামে মসজিদ। ৩৬১ বর্গফুট ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মূল মসজিদ ভবনের উচ্চতা ১৬ ফুট। এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটি মাটি থেকে তিন ফুট উঁচু ভিটির ওপর। এতে রয়েছে একই মাপের তিনটি খিলান দরজা। মসজিদটির কয়েক ফুট দক্ষিণে ভিন্ন আরেকটি ভিটির ওপর ১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১১ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট একটি বৈঠকখানা রয়েছে।

ধারণা করা হয় ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান বরবকশাহের রাজত্বকালে নির্মাণ করা হয় গুরিন্দা জামে মসজিদ। অবশ্য বরবকশাহের চন্দ্রদ্বীপ বিজয়ের আগেই মুসলমানদের আগমন ঘটে এ অঞ্চলে। দীর্ঘদিন ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢাকা পড়েছিল গুরিন্দা জামে মসজিদ। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বাহাদুরপুরের পীর সাহেব বাদশা মিয়া এলাকায় সফরে এসে এলাকা আবাদ করে মসজিদ আবিষ্কার করেন এবং নিজে ওই মসজিদে জুমা নামাজ আদায় করেন। একই সঙ্গে মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করার জন্য এলাকাবাসীকে বলে যান। এরপর থেকে মসজিদটিতে নিয়মিত নামাজ আদায় করা হয়।

প্রাচীন দীঘি ও পুকুর:
বিভিন্ন আমলে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে প্রায় দুই হাজার দীঘি খনন করা হয়। এগুলোর মধ্যে মাধবপাশার দুর্গাসাগর দীঘি, পটুয়াখালীর কারখানা, বাকেরগঞ্জের কবিরাজের দীঘি, বানারীপাড়ার লস্করপুরের দীঘি, উজিরপুরের শোলকের মলুয়ার দীঘি, গৌরনদীর ছবি খাঁর পার, হিজলা থানার জমাদার বাড়ির দীঘি ও বাউফলের কমলা রানীর দীঘি আকার আয়তনের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। মূলত তৎকালীন শাসকরা এলাকার মানুষের সুপেয় পানীয়জলের প্রয়োজন মেটাতে এসব দীঘি খনন করেন। আর এসব দীঘির প্রায় প্রত্যেকটি ঘিরে মানুষের মুখে মুখে এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র কিংবদন্তি। যা ইতিহাসেরও উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বরিশালের দুর্গাসাগর দীঘি:
প্রাচ্যের ভেনিস নামে খ্যাত বরিশাল জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বানারীপাড়া সড়কের পাশে মাধবপাশার বিশাল এলাকাজুড়ে দুর্গাসাগর দীঘির অবস্থান। তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের পঞ্চদশ রাজা শিব নারায়ণের মৃত্যুর পরে লক্ষ্মীনারায়ণ ১৭৭৭ খিস্টাব্দে রাজত্ব লাভ করেন। এর কিছু দিনের মধ্যে লক্ষ্মীনারায়ণের মৃত্যু হলে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে রানী দুর্গাবতী সাত লাখ টাকা রাজস্ব পরিশোধ করে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের সনদ নবায়ণ করান। এ সময় তিনি সন্তানসম্ভবা ছিলেন। কিন্তু সন্তানের জন্ম না হওয়ায় দুর্গাক্রোড় নারায়ণের নামে সনদ নেওয়া হয়।

এ কারণে পরবর্তীকালে রানীর ছেলে রাজা জয়নারায়ণের আরেক নাম রাখা হয় দুর্গকুর নারায়ণ। জয়নারায়ণ শিশু থাকায় রানী দুর্গাবতী রাজ্য পরিচালনা করতেন। তৎকালীন বাংলায় যে কজন নারী রাজত্ব পরিচালনায় স্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, রানী দুর্গাবতী তাদের অন্যতম। তিনি একাধারে বুদ্ধিমতী এবং অন্যধারে প্রজাবৎসল মহিলা ছিলেন। তিনি ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী শ্রীনগর বা মাধবপাশায় নিজ নামে দুর্গাসাগর দীঘি খনন করান। কথিত আছে এক রাতে রানী যতদূর হেঁটে যেতে পারেন দীঘির আয়তন ততটাই করা হয়। এতে দীঘির আয়তন ১৩ দ্রোন বা ৬১ কানিজমিতে দাঁড়ায়। দীঘি খননে কয়েক হাজার শ্রমিকের সময় লাগে পুরো ৬ মাস। শ্রমিকরা সারা দিনের কাজের শেষে পশ্চিম পাশে আরেকটি দীঘিতে কোদাল পরিষ্কার করত। এ কারণে ওই দীঘির নাম হয় কোদাল-ধোয়া দীঘি। দুর্গাসাগর দীঘি খননে খরচ হয় তিন লাখ টাকা।

রানী দীঘির চারপাশে চারটি বিশাল পাকা ঘাটও নির্মাণ করেছিলেন। দীঘির পশ্চিমে শ্রীপুর, পূর্বে কলাডেমা, উত্তরে পাংশা এবং দক্ষিণে শোলনা ও ফুলতলা গ্রাম। দুর্গাসাগর দীঘির পাশে এখনো রানী দুর্গাবতীর রাজপ্রসাদ রয়েছে। প্রায় ১০ একর জমি নিয়ে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্যতম স্মৃতিচিহ্ন হয়ে প্রসাদটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এ প্রসাদটিও দর্শনার্থীদের বেশ নজর কাড়ে। চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের পতনের পরে প্রায় দুই শ বছর দুর্গাসাগর দীঘি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৪-৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত আগ্রহ-অনুদানে তৎকালীন ভূমি ও রাজস্বমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দুর্গাসাগর দীঘির সংস্কার করা হয়। বর্তমানে এটি বরিশালের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র।

বাকলার আরেক ঐতিহ্য কমলা রানীর দীঘি:
বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের অপুত্রক রাজা জয়দেব ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যাওয়ার পর সিংহাসনে আরোহণ করেন তার বড় মেয়ে কমলা সুন্দরী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী, বিদুষী এবং দৃঢ়চেতা। কমলারানী স্বাধীনভাবে দীর্ঘদিন চন্দ্রদ্বীপরাজ্য শাসন করেন। তার স্বামীর নাম ছিল বলভদ্র বসু। কথিত আছে, বলভদ্র বসু দেখতে কালো ছিলেন। তাই প্রজারা তাকে কালারাজা বলত। গলাচিপার কালারাজার বিল তার নামেই নামকরণ হয়েছে। কালারাজার বিল বর্তমানে কালারাজা গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এক সময়ে এখানে রাজপ্রসাদ ছিল।

রাজা জয়দেবের দুই মেয়ে কমলা সুন্দরী ও বিদ্যা সুন্দরী। রাজা তার দুই মেয়েকেই উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। দুই বোনের মধ্যে কমলা ছিলেন প্রতিভাময়ী। বাবার নির্দেশে তিনি রাজ্য পরিচালনা ও অস্ত্র চালনা শিক্ষা লাভ করেন। রাজ্যের শ্রেষ্ঠ প-িতদের নিকট তিনি সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় জ্ঞান লাভ করেন। বিভিন্ন শাস্ত্রেও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। রাজা জয়দেব কমলা সুন্দরীকে বাবুগঞ্জ থানার দেহেরগতি গ্রামের উষাপতির পুত্র বলভদ্র বসুর সঙ্গে বিয়ে দেন। দেহেরগতির বসু পরিবার কৌলীন্য ও শিক্ষায় অগ্রগামী ছিল। বিদ্যোৎসাহী বলভদ্র বসু বিভিন্ন শাস্ত্রে প-িত ছিলেন। যুদ্ধবিদ্যায় তিনি ছিলেন বাকলা রাজ্যের মধ্যে অতুলনীয়। বলভদ্র বসুর গুণে মুগ্ধ হয়ে রাজা জয়দেব তাকে জামাতা হিসেবে গ্রহণ করেন।

বিয়ের পর রাজকুমারী কমলা দেহেরগতি চলেন যান। সেখানে কিছু দিন থাকার পর স্বামী বলভদ্র বসুসহ বাকলার রাজধানীতে ফিরে আসেন। বাবা রাজা জয়দেবের নির্দেশে তাদের জন্য নির্মিত বাড়িতে বসবাস করেন। তাদের দিনগুলো ছিল সুখকর। মৃত্যুর আগে রাজা জয়দেব কমলাকে সিংহাসনের উত্তরাধীকারী ঘোষণা করেন। ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে রাজকুমারী কমলা বাকলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্বামী বলভদ্র বসু তাকে রাজকার্যে সহায়তা করতেন। রাজ্য শাসন ও প্রজা পালনে কমলা অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ওই সময় গৌড়ের সুলতান ছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্। প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য রানী কমলা রাজ্যে অনেক বড় বড় দীঘি খনন করেন। এগুলোর মধ্যে কমলার দীঘি ও বিদ্যা সুন্দরীর দীঘি অন্যতম।
রানী কমলা নিজের নামে রাজ্যে বৃহত্তম দীঘি খনন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিন দরুন ১৩ কানি অর্থাৎ একশ একর ভূমি নিয়ে দীঘি খনন করার জন্য সভাসদদের নির্দেশ দেন রানী কমলা। এক সময় দীঘি কাটা শেষ হলো। কালারাজার আত্মহত্যার কাহিনী নিয়েও বিতর্ক আছে। কারণ কমলার মৃত্যুর পর তিনি পুত্র পরমানন্দ বসুর অভিভাবক হিসাবে অনেকদিন রাজ্য শাসন করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।

রানী কমলার মৃত্যু কাহিনীও বিশ্বাস যোগ্য নয়। তবে এ কথা ঠিক যে, তিনি ওই দীঘিতে ডুবেই মারা যান। ধারণা করা হয় রানী কমলা সেদিনের ব্রাহ্মণ ও জ্যোতিষীদের অন্ধ বিশ্বাসের শিকার হয়েছিলেন। তাদের পরামর্শেই সরলমতি কমলা দীঘির মাঝখানে গিয়ে পূজা দিয়েছিলেন। খুব সম্ভব রানীর বিরোধিতাকারী একদল কর্মচারী ওই সময় দীঘির এক পাড় কেটে দেয় এবং সে স্থান দিয়ে তেঁতুলিয়া নদীর জোয়ারের স্রোত দীঘিতে ঢুকে পড়ে। সময় রানী কমলাকে উদ্ধারের জন্য কেউ কোনো চেষ্টা করেনি। কমলা পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন। রানী কমলার করুণ মৃত্যু কাহিনী বাকলা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই তার মৃত্যুতে হতভম্ব হয়ে যায়। পরবর্তীকালে কমলার করুণ মৃত্যুকাহিনী নিয়ে রচিত হয় অজ¯্র সাহিত্যকর্ম, গান। শত বছর ধরে কমলার বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে তৈরি গান এ অঞ্চলে গীত হচ্ছে।

চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের পতন :
রাজা জয়নারায়ণকে (দুর্গাকুর) চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের শেষ রাজা বলা হয়। তবে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে জয়নারায়ণের মৃত্যুর পর রাজা নৃসিংহ নারায়ণ রাজ ক্ষমতায় আসেন। তখন চলছিল রাজপরিবারের অর্থনৈতিক ভগ্নদশা। নৃসিংহ নারায়ণের মা করুণাময়ী নৃসিংহকে অল্প বয়সেই দুটি বিয়ে করান। তার প্রথম স্ত্রীর নাম অন্নপূর্ণা ও দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম রাজেশ্বরী। নৃসিংহ নারায়ণের দুই স্ত্রীর কারোই কোনো সন্তান হয়নি। যদিও তারা একাধিক দত্তক গ্রহণ করেছিলেন। রাজা নৃসিংহ নারায়ণই চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের শেষ কর্ণধার। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চারশ বছরের প্রাচীন রাজপরিবারের দীর্ঘ ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। একদিন যারা মগ-পর্তুগীজ ও মুঘলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, আজ তাদের ঐতিহাসিক কীর্তিগুলোও নেই। শুধুমাত্র রানী দুর্গাবতীর স্মৃতিবিজড়িত দুর্গাসাগর দীঘিটি রাজপরিবারের চিহ্নহ্ন বহন করছে।

কবি বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ :
হুসেন শাহী আমলে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল। বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বিজয় গুপ্ত রচনা করেন মনসামঙ্গলবা পদ্মপুরাণ। বিজয় গুপ্ত ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের ফুল্লশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সনাতন কোটালীপাড়ার অধিবাসী ছিলেন। বাকলা অঞ্চলে সেন আমল হতে মনসার পূজা প্রচলিত ছিল। কবি বিজয় গুপ্ত দেবী মনসার ভক্ত ছিলেন। মনসামঙ্গলকাব্যের স্বপ্নাধ্যায়ে তিনি উল্লেখ করেন, মনসা দেবী কর্তৃক স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে তিনি মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণকাব্য রচনা করেন। কথিত আছে কাব্য রচনার আগে তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে গৈলার মনসাবাড়ির দীঘি হতে মনসা পূজার ঘট ও কোষা উদ্ধার করেন।

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার সেই ফুল্লশ্রী গ্রাম আজও আছে। আছে ছাতিম বৃক্ষ। যার সামনেই প্রাচীন মন্দিরটি আধুনিক রূপে নির্মিত হয়েছে। কবি নিজেই মনসামঙ্গল কাব্য লেখার কারণ বর্ণনা করে লিখেছেন ।  ‘শ্রাবণ মাসের রবিবার মনসা পঞ্চমী/দ্বিতীয় প্রহর রাত্রি নিদ্রাময় স্বামী/ নিদ্রায় ব্যাকুল লোক না জাগে একজন/হেনকালে বিজয়গুপ্ত দেখিল স্বপন।’  কবি বিজয় গুপ্ত স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মনসার যে কাব্য রূপ লিখেছেন তা মনসামঙ্গল নামে পরবর্তীতে আদৃত হয়েছে। যদিও বিপ্রদাস পিপলাইসহ তৎকালীন বহু কবিই মনসামঙ্গল রচনা করেছেন, তারপরেও বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল রচনার প্রসাদগুণে অনন্য। তৎকালীন সময়ে চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশ শুধু নয়, গৈলা-আগৈলঝাড়া অঞ্চলটি প-িতনগর হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। বৈদ্যবংশীয় বহু প-িত এ সময়ে পা-িত্যে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কবি নিজেই সে সময়ের সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। ‘পশ্চিমে গর্গর (ঘাঘট) নদী পূর্বের ঘন্টস্বর।

মধ্যে ফুলশ্রী গ্রাম প-িতনগর।’ মনসামঙ্গল কাব্যে রচনার সময়কাল বর্ণনায়ও কবি বিজয় গুপ্ত সাংকেতিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। ‘ঋতু শশী বেদশশী পরিমিত শক। সুলতান হোসেন রাজা নৃপতি তিলক।’ অর্থাৎ ছয় ঋতু, এক শশি (চাঁদ), চার বেদ এবং এক শশি। সে হিসেবে হয় ৬১৪১। এই সংখ্যা উল্টিয়ে লিখলে হয় ১৪১৬। স্বভাবতই ‘শক’ উল্লেখ শকাব্দ প্রচলিত। এর সঙ্গে ৭৮ যোগ করলে পাওয়া যায় খ্রিস্টাব্দ। সে হিসেবে ১৪১৬+৭৮=১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের সময়কাল। তবে কেউ কেউ এ সময়কাল সামান্য আগে পরে উল্লেখ করেছেন।

মনসামঙ্গল কাব্যের প্রাচীনত্ব যাই হোক। এর বিশেষত্ব হচ্ছে আজ দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা সুর করে মনসামঙ্গল পাঠ করে। যা এ অঞ্চলে ‘রয়ানি’ নামে বিশেষভাবে পরিচিত। মনসামঙ্গল কাব্যে গ্রামীণ জনপদের বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবন খাদ্যাভাস, জীবনযাপন, অন্তরঙ্গ সাংসারিক জীবন এমনভাবে উঠে এসেছে যা শুধু দেবী সুলভ মাহাত্ম্য নয়, আমাদের রোজকার জীবন ধারাকেই উপস্থাপন করে। তাই কাব্য নয় ‘মনসামঙ্গল’ দক্ষিণের খেটে খাওয়া মানুষের পাঁচ শতাধিক বছর আগের জীবন্ত দলিল।

আরও কিছু কীর্তি :
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মাহিলারা গ্রামে রয়েছে প্রাচীন আমলের একটি মঠ। যা হিন্দু স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। মঠটি নির্মাণ করেছিলেন জনৈক রূপরাম সরকার। তিনি নবাব আলীবর্দি খানের কর্মচারী ছিলেন। মঠটি নবাবের নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল। মঠের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দেবদেবির ছবি খোদিত রয়েছে। পিরোজপুরের রায়েরকাঠি গ্রামে জমিদার রুদ্রনারায়ণের নির্মিত মন্দির এ অঞ্চলের আরেক দর্শনীয় স্থান। এটি ১৭৩৭ সালে নির্মিত হয়। বরিশালের বাকেরগঞ্জের কলসকাঠি গ্রামে রয়েছে তেরোটি জমিদার বাড়ি।




কবি সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

বরিশাল অফিস : নারীমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণতান্ত্রিক ও  প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রদূত জননী সাহসিকা কবি বেগম সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।

তার জন্ম ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালে। তখন বাঙালি মুসলমান নারীদের লেখাপড়ার সুযোগ একেবারে সীমিত থাকলেও তিনি নিজ চেষ্টায় লেখাপড়া শেখেন এবং ছোটবেলা থেকেই কবিতাচর্চা শুরু করেন।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর জন্ম দিন উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ললিত ভাষায় ও ব্যঞ্জনাময় ছন্দে তার কবিতায় ফুটে উঠত সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ ও সমাজের সার্বিক চিত্র। তিনি নারীসমাজকে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মহান ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার, মুক্তিযুদ্ধসহ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলনে তিনি আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা।

কবি সুফিয়া কামাল পিছিয়ে পড়া নারী সমাজের শিক্ষা ও অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অবদানের জন্য তাকে ‘জননী সাহসিকা’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি বেগম সুফিয়া কামালের সাহিত্যে সৃজনশীলতা ছিল অবিস্মরণীয়। শিশুতোষ রচনা ছাড়াও দেশ, প্রকৃতি, গণতন্ত্র, সমাজ সংস্কার এবং নারীমুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার লেখনী আজও পাঠককে আলোড়িত ও অনুপ্রাণিত করে।

সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বিকেল ৩টায় বরিশালের শায়েস্তাবাদের রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এই আন্দোলনে নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন।

পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন এবং তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন।

১৯৭০ সালে তিনি মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে নারী জাগরণ ও নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণসহ কার্ফু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেন।

সাঁঝের মায়া, মন ও জীবন, শান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া সোভিয়েতের দিনগুলো এবং একাত্তরের ডায়েরি তার অন্যতম ভ্রমণ ও স্মৃতিগ্রন্থ।

সুফিয়া কামাল দেশবিদেশের ৫০টিরও বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সোভিয়েত লেনিন পদক, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পদক।

সুফিয়া কামালের পাঁচ সন্তান। তারা হলেন– আমেনা আক্তার, সুলতানা কামাল, সাঈদা কামাল, শাহেদ কামাল ও সাজেদ কামাল।




বরিশালে সপ্তাহব্যাপী বইমেলার উদ্বোধণ

বরিশাল অফিস: নগরীর ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু উদ্যানে সপ্তাহব্যাপী বিভাগীয় বইমেলা বুধবার বিকেলে উদ্বোধণ করা হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম মেলার উদ্বোধণ করেছেন।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহযোগিতায়, বরিশাল বিভাগীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের আয়োজনে বিভাগীয় বইমেলা চলবে আগামী ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলবে এ বইমেলা।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মোঃ শওকত আলীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নাফরিজা শ্যামা, বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি মোঃ জামিল হাসান, পুলিশ কমিশনার মোঃ সাইফুল ইসলাম, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর, জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পরিচালক নেসার উদ্দিন আয়ূব প্রমুখ।

বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) ও বইমেলার সমন্বয়ক মনদীপ ঘরাই বলেন, সপ্তাহব্যাপী এই বইমেলায় সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ১৯টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা থেকে স্বনামধন্য ৩৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় স্টল নিয়ে অংশগ্রহণ করেছে। এছাড়াও স্থানীয় সাহিত্য সংগঠন, সাহিত্য বাজার পত্রিকাসহ ৭০টির বেশি স্টল রাখা হয়েছে।

তিনি আরও জানিয়েছেন, ৯ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত বরিশালের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিশু একাডেমি থেকে আগত শিক্ষার্থীদের নিয়ে কচিকাচাঁর উৎসব, চিত্রাঙ্কন, বিতর্ক ও কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া মেলা প্রাঙ্গনে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।




লেখিকা কুসুম কুমারী দাশ স্মরণে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা

বরিশাল অফিস: শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মা ‘আমার দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’ কবিতার লেখিকা বরিশালে আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা দাশের বাড়ীর সন্তান কুসুম কুমারী দাশ স্মরণে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত।

শিশু কিশোরদের অংশগ্রহণে তাদের তুলির আচরে রূপসী বাংলার প্রকৃতি ও গ্রাম বাংলার চিত্র প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।

এর আগে কুসুম কুমারী দাশ স্মরণে কবিতা পাঠ প্রতিযোগিতা গৈলা দাশের বাড়ীর অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে উপজেলার ৪ শতাধিক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন।চিত্রাংকন ও কবিতা প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়ে থাকে। একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা অজয় দাশ গুপ্ত বলেন, লেখিকা কুসুম কুমারী দাশের গৈলা দাশের বাড়ীর সন্তান তাই তার স্মরণে কয়েক যুগধরে প্রতিবছর শারদীয় দুগোৎসব এর সময় শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকি।

এক সাথে এবছর ৪ শতাধিক শিশু প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। একদিকে শিশুদের মাঝে আনন্দ ও মেধা বিকাশ হয় অন্যদিকে কুসুম কুমারী দাশের বিষয়ে জানতে পারে। বিজয়ী প্রতি যোগিদের মাঝে পুরুস্কার বিতরণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিন চারুকলা ইনিস্টিউট অধ্যাপক নিসার হোসাইন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুশিল্পী দিলারা বেগম জলি, হাই কোর্ট সহকারি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত।




আগৈলঝাড়ায় কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম নিয়ে সেমিনার

বরিশাল অফিস: বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার বাকাল ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামে সোনার বাংলা নবীন সংঘের আয়োজনে সংঘ চত্ত্বরে শুক্রবার সকাল থেকে দিনব্যাপী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীর উপরে এক সেমিনার ও নজরুল সংগীতের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন শিক্ষক, সাংবাদিক, ছাত্র-ছাত্রী, সাংস্কৃতিককর্মী ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সোনার বাংলা নবীন সংঘর সভাপতি তপন কুমার অধিকারী।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিদ্রোহী ও সাম্যবাদী চেতনার কবি। দেশ স্বাধীনের সময় তার লেখনির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিলেন “কারার ঐ লোহকপাট, ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট, রক্ত-জমাট” এ রকম অসংখ্য কবিতার ও গান লিখেছিলো।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী নিয়ে বক্তব্য রাখেন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা সহদেব বৈদ্য, নজরুল গবেষক প্রফেসর ড. প্রদীব কুমার নন্দী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার সরকার, সোনার বাংলা নবীন সংঘর সাধারণ সম্পাদক শিল্পী বাগ্চী, রতন রায়।

শেষে সন্ধ্যায় নজরুল সংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।




সফলতার জন্য ‘টার্গেট’ নাকি ‘হ্যাবিট’ কোনটা গুরুত্বপূর্ণ?

লতিফুর রহমান: ছোটবেলায় পড়েছিলাম নির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকা মানে হচ্ছে লক্ষ্যহীন নৌকার মতো। অর্থাৎ ‘এইম ইন লাইফ’ ছাড়া জীবনে সফলতা সম্ভব না। অথচ লেখক জেমস ক্লিয়ার এটা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। তিনি বললেন,

১. একই লক্ষ্য থাকার পরও খেলাধুলায় কেউ বিজয়ী ও কেউ পরাজিত হয়। তাহলে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়াও আরও কিছু রয়েছে যা সফলতার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

২. লক্ষ্য অর্জনের পর মানুষ হতাশায় ভুগে। কারণ লক্ষ্য অর্জনের পর কী করবে সেটা বুঝতে পারে না। অলিম্পিকে সোনা জিতে অনেকের নাকি এমন দশা হয়েছে।

৩. অনেক সময় লক্ষ্য অর্জনের পর সেটা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। যেমন- পরীক্ষার আগে রাতদিন পড়াশোনা করি কিন্তু পরীক্ষা শেষে বই আর ছুয়েও দেখি না। বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য নামাজ পড়ি। বিপদ কেটে যেতেই আল্লাহকে ভুলে যাই।

৪. প্রতিবার আমার লক্ষ্য থাকে ঘর পরিস্কার রাখা। তাই কিছুদিন পরপর সময় নিয়ে পরিশ্রম করি। এর মানে হচ্ছে রেজাল্টকে সমস্যা মনে করছি। অথচ যেই অপরিস্কার অভ্যাসের কারণে ঘর নোংরা হয় সেটাকে সমস্যা মনে করা উচিত।

এজন্য লক্ষ্য অর্জনের চাইতে অভ্যাসকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন লেখক জেমস ক্লিয়ার।

এদিকে আরেক জনপ্রিয় লেখক সাইমন সিনেক বলেন, Goal বা লক্ষ্য থাকার যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেটার সমাধান হচ্ছে ‘ভিশন’।

গোল হচ্ছে এমন বিষয় যেটার নির্দিষ্ট মাইলস্টোন রয়েছে। কিন্তু ভিশনের কোনো মাইলস্টোন নেই। যেমন ডাক্তার হয়ে মানুষের উপকার করা। দোকানদারের ভিশন হচ্ছে ক্রেতার কাছে সর্বদা কোয়ালিটি পণ্য বিক্রি করা। অর্থাৎ মরণের আগ পর্যন্ত ভিশনের পেছনে মানুষ ছুটবে।

তাই আগামী একমাসে ৩ কেজি ওজন কমাবো এটা হচ্ছে গোল। কিন্তু ভিশন হচ্ছে সর্বদা সুস্থ থাকা। ফলে ওজন টার্গেটের মধ্যে এলেও সর্বদা স্বাস্থ্যকর ও পরিমিত খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হবে।

তাদের কথাবার্তা থেকে যেটা বুঝেছি সেটা হচ্ছে গোল, ভিশন ও অভ্যাস সবই গুরুত্বপূর্ণ। একেক বিষয় একেক রকম উপকারের জন্য।

শেষ করছি জেমস ক্লিয়ারের একটা কথা থেকে। তিনি বলছেন, মানুষ যদি প্রতিদিন শতকরা এক ভাগ উন্নতি করে তাহলে বছর শেষে তার ৩৭ গুণ উন্নতি হবে।

তাই আসুন, নিজের ভিশন ঠিক করি। সেটাকে ভেঙে ছোট ছোট টার্গেট সেট করি এবং দিনে দিনে কিছু ভালো অভ্যাস গড়ে তুলি।